০৪:৫১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫

অভিনব কৌশলে স্বর্ণ চোরাচালান

ডেস্ক নিউজ:
  • আপডেট সময়ঃ ০৫:৪৪:৩৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ৭ মে ২০২৫
  • / ২৪ বার পড়া হয়েছে।

দেশে স্বর্ণের চোরাচালান ঠেকানো যেন অসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বন্দরগুলোতে কয়েক স্তরের স্ক্যানার, বিভিন্ন সংস্থার গোয়েন্দা নজরদারি ও ডিজিটাল ম্যানুয়াল যাচাইয়ের পরও দেশের বাজারে দেদার ঢুকছে স্বর্ণের চোরাচালান। অন্যদিকে এসব স্বর্ণ আনতে বর্তমানে এমন আজব সব কৌশল প্রয়োগ হচ্ছে, যেগুলো ধরতেও ঘাম ছুটে যাচ্ছে গোয়েন্দাদের।

বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) তথ্যমতে, গত বছর দেশের জল, স্থল ও আকাশপথে প্রায় ৯১ হাজার ২৫০ কোটি টাকার চোরাই স্বর্ণ, অলংকার বাংলাদেশে ঢুকেছে। এতে প্রশ্ন উঠেছে, এতগুলো ধাপ পেরিয়েও কীভাবে এই বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ ঢুকছে। তাহলে কি রক্ষকই ভক্ষকের ভূমিকায় আছে।

একাধিক সংস্থার দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলেছেন, বিমানবন্দর টার্মিনালে স্ক্যানের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি, উড়োজাহাজের পাইলট, কেবিন ক্রুসহ ফ্লাইট পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এই স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। অভ্যন্তরে কাজ করা একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী চোরাকারবারি চক্রের সদস্য। তা না হলে এমন সুরক্ষিত কয়েকটি ধাপ পেরিয়ে স্বর্ণ আনা-নেওয়া করা সম্ভব নয়। ফলে স্বর্ণের চোরাচালান ধরতে আগে ‘সর্ষের মধ্যের ভূত’ তাড়াতে হবে।

স্বর্ণ চোলাচালানের অভিনব এই কৌশল দেখে শুধু কাস্টমস কর্মকর্তারাই নন; চোখ কপালে উঠছে সিআইডি, শুল্ক গোয়েন্দা, এপিবিএনসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সদস্যদের। ঢাকা কাস্টম হাউসের যুগ্ম কমিশনার সুমন দাসের মতে, নতুন-পুরোনো এমন অন্তত অর্ধশতাধিক কৌশল বের করেছেন স্বর্ণ চোরাকারবারিরা; যাদের চিহ্নিত করতে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোকে। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, একদিকে স্বর্ণ চোরাচালান যেমন বাড়ছে, তেমনি স্বর্ণ বহনেও দেখা যাচ্ছে আজব সব কৌশল। যদিও কারবারিদের দমাতে সতর্ক রয়েছে কাস্টমস, কাস্টমস গোয়েন্দাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

এমনই একটি অভিনব কৌশল ধরা পড়ে গত ২৫ এপ্রিল বেলা সোয়া ১১টার দিকে। এদিন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে দুবাই থেকে সিলেট হয়ে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন ৩৮ বছর বয়সী শাহজাহান। কাস্টমস কর্মকর্তাদের কাছে সন্দেহজনক হওয়ায় ওই যাত্রীর পোশাক খুলে হাতে নেওয়া হলে ‘অস্বাভাবিক ওজন’ মনে হয়। পরে তার চারটি ‘আন্ডারওয়্যার’ একটি ফুল প্যান্ট ও তিনটি টি-শার্ট আগুনে পুড়িয়ে ডাস্টসহ ২ হাজার ৫৬০ গ্রাম স্বর্ণের পাউডার উদ্ধার করে কাস্টমস। পরে পরিশোধন করে ২ কেজি ৪১৭ গ্রাম স্বর্ণ পাওয়া যায়। জব্দ করা ওই স্বর্ণের আনুমানিক মূল্য প্রায় ৫ কোটি টাকা। পোশাকে ভরে আনা আড়াই কেজি স্বর্ণ বহনের জন্য ওই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে বিমানবন্দর থানায় মামলা করা হয়েছে।

বিমানবন্দরগুলোতে কাজ করা কর্মকর্তারা বলেছেন, নতুন-পুরোনো মিলে অর্ধশতাধিক কৌশলে কারবারিরা দেশে স্বর্ণের চালান নিয়ে আসছে। খুব সহজে যাতে শনাক্ত করা না যায়, সে জন্য স্বর্ণের বারের ওপর কালো ও সিলভারের প্রলেপ দেওয়া হচ্ছে। এই কাজে ফ্লাইট বা উড়োজাহাজের পাইলট, কেবিন ক্রু, ইঞ্জিনিয়ার, ট্রলিম্যান, ক্লিনার ও মালপত্র স্ক্যানের দায়িত্বে যারা রয়েছেন তাদের অনেকে চক্রের হয়ে কাজ করছেন।

সম্প্রতি যেসব কৌশল ধরা পড়েছে তার মধ্যে রয়েছে- জুতা, বেল্ট, কোমরবন্ধনী, শার্টের কলার, স্যান্ডেল, সাবান কেস, সাউন্ড বক্স, আন্ডারওয়্যারের ভেতর বিশেষ কায়দায় স্বর্ণ বহন। পাশাপাশি মানিব্যাগ, গলায় স্বর্ণের চেইনের সঙ্গে লকেট হিসেবে ঝুলিয়েও স্বর্ণের বার আনা হচ্ছে। এ ছাড়া হুইলচেয়ারে রোগী সেজে, ওষুধের কৌটা ও বিভিন্ন ধরনের খাবারের প্যাকেটেও চোরাই স্বর্ণ আনা হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা কাস্টম হাউসের যুগ্ম কমিশনার সুমন দাস বলেন, ‘স্বর্ণ চোরাচালান বাড়ার পাশাপাশি কৌশলও পরিবর্তন করছেন কারবারিরা। এ বিষয়ে ঢাকা কাস্টম হাউসসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সতর্ক রয়েছেন। প্রতিটি শিফটে তদারকি ও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া নতুন কৌশলে দুই বা তিন কেজির চালান আনলেও সেগুলো ধরা হচ্ছে। চোরাকারবারিরা নিত্যনতুন কৌশল ব্যবহার করলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সতর্ক রয়েছেন।’

গত ১২ মার্চ চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সৌদি আরবের জেদ্দা থেকে আসা এক যাত্রীর কাছ থেকে ১২টি ২২ ক্যারেট স্বর্ণের চুড়ি জব্দ করা হয়, যার বাজারমূল্য প্রায় ৫০ লাখ ৬৯ হাজার ২০০ টাকা। এর আগে গত ৮ ফেব্রুয়ারি কুয়েত থেকে আসা জাজিরা এয়ারলাইনসের একটি বিমানের এক যাত্রীর কাছ থেকে দুই কেজি স্বর্ণ ও ১৪ ফেব্রুয়ারি সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফ্লাইটের সিটের নিচে লুকানো আটটি স্বর্ণের বার জব্দ করা হয়। একই মাসের ১৫ তারিখ সৌদি আরবে ওমরাহ পালন শেষে দেশে ফেরা এক যাত্রীর কাছ থেকে একটি ব্লেন্ডার মেশিনে লুকানো তিন কেজি ও ১৭ তারিখ সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দরে ফ্যানের ভেতরে করে আনা ১৭ কেজি স্বর্ণ জব্দ করা হয়।

এ ছাড়া গত বছরের ৩ ডিসেম্বর মালয়েশিয়া থেকে আসা পাঁচ যাত্রীর কাছ থেকে প্রায় সাত কেজি স্বর্ণ ও ২৭ ডিসেম্বর শাহ আমানত বিমানবন্দরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটের ভেতর থেকে ২০টি স্বর্ণের বার জব্দ করা হয়। সর্বশেষ গত রবিবার দিবাগত রাতে শাহজালাল বিমানবন্দরে স্বর্ণালঙ্কার তৈরির মেশিনের ভেতর থেকে ১ কেজি ২০০ গ্রাম স্বর্ণ জব্দ করা হয়।

নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো জানাচ্ছে, হযরত শাহজালাল, শাহ আমানত এবং ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে ব্যবহার করে নতুন নতুন কৌশলে দেশে স্বর্ণ আনছে মধ্যপ্রাচ্য ও দুবাইভিত্তিক একটি চক্র। শুল্ক ফাঁকি দিতে এমন তৎপরতা আগে এত বেশি চোখে পড়েনি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। একাধিক কাস্টমস কর্মকর্তা জানান, আগে স্বর্ণ আনতে লাগেজ ও শরীর ব্যবহার করা হতো। কিন্তু এখন রোগী সেজে, স্বর্ণ গুঁড়া করে সেগুলো অন্য কোনো পদার্থ উল্লেখ করে পার হওয়ার চেষ্টা চলছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা (ডিআইজি) বলেন, ‘উড়োজাহাজে ওঠার আগে প্রবেশ গেটে শরীর, লাগেজ ও মালপত্র স্ক্যানার মেশিনের মাধ্যমে চেক করে প্রবেশ করানো হয়। সেখানে একটি আলপিনও চোখ ফাঁকি দিয়ে ঢোকানো সম্ভব নয়। কিন্তু আমরা দেখছি, ওজনে বিপুল পরিমাণ বা কোটি কোটি টাকার স্বর্ণ জব্দ করা হচ্ছে। এখানে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে এই স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে স্ক্যানের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি, উড়োজাহাজের পাইলট, কেবিন ক্রুসহ অভ্যন্তরে কাজ করা একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত। তাদের সহযোগিতা ছাড়া এভাবে স্বর্ণ আনা সম্ভব নয়।’

সিআইডির ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, বিমানবন্দরে শিফটিং ডিউটি থাকে। অনেক সময় চক্রের কেউ উপস্থিত না থাকলে সেগুলোই সাধারণত ধরা পড়ে। যে পরিমাণ স্বর্ণের চোরাচালান প্রতিদিন আসে, তার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ নানাভাবে ধরা পড়ে। অন্যদিকে চালানসহ যারা ধরা পড়েন তারা মূলত বাহক। বাহক বা ক্যারিয়ারকে ধরে চোরাচালান প্রতিরোধ করা কঠিন। চোরাচালান ধরতে ‘সর্ষের মধ্যে ভূত’ বলে যে প্রবাদ আছে আগে সেই ভূত তাড়াতে হবে।

বাজুসের তথ্যমতে, গত বছর দেশের জল, স্থল ও আকাশপথে প্রতিদিন গড়ে কমপক্ষে ২৫০ কোটি টাকার অবৈধ স্বর্ণের অলংকার, স্বর্ণের বার, ব্যবহৃত পুরোনো জুয়েলারি (যা ভাঙারি হিসেবে বিবেচিত হয়) ও হীরার অলংকার (ডায়মন্ড জুয়েলারি) চোরাচালানের মাধ্যমে বাংলাদেশে আসে, বছর শেষে যার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৯১ হাজার ২৫০ কোটি টাকার বেশি। পুরো এই টাকা হুন্ডির মাধ্যমে চোরাকারবারিরা বিদেশে পাচার করে থাকে বলে জানায় বাজুস।

এ প্রসঙ্গে বাজুসের সহসভাপতি মাসুদুর রহমান বলেন, দেশের জল, স্থল ও আকাশপথ ব্যবহার করে বছরে ৯১ হাজার ২৫০ কোটি টাকার স্বর্ণ ঢুকছে দেশে, তা আবার ডলার হয়ে চলে যাচ্ছে বাইরের দেশে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন দেশের বৈধ বা অনুমোদিত ব্যবসায়ীরা। তিনি বলেন, স্বর্ণ চোরাচালান কমাতে হলে সরকারের এই ব্যবসার শুল্ক কমাতে হবে ও সহজ শর্তে স্বর্ণ আনার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। বিমানবন্দরে ওয়ান স্টপ সেন্টারের পাশাপাশি পরীক্ষা-নীরিক্ষা শেষে ২ ঘণ্টার মধ্যে ছেড়ে দিতে হবে। শুল্ক কমালে চোরাচালান কমে আসবে, যা ব্যবসায়ী ও দেশের জন্য মঙ্গলজনক বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

এ বিষয়ে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) সৈয়দ মুশফিকুর রহমান বলেন, ‘স্বর্ণ চোরাকারবারিদের দমাতে গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ও সোর্স বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), কাস্টম হাউসসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর দায়িত্বশীলদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করা হচ্ছে। পাশাপাশি ‘কাস্টমস বিটে’ নিজস্ব টিমও কাজ করছে।’ তিনি জানান, চোরাচালানের নতুন কৌশল ধরতে গোয়েন্দারাও বিভিন্ন ধরনের পক্ষক্ষেপ নিচ্ছেন। এ কারণে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে চোরাচালানও ধরা পড়ছে।

নিউজটি শেয়ার করুন
ট্যাগসঃ

বিস্তারিত লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষণ করুন

আপলোডকারীর তথ্য

অভিনব কৌশলে স্বর্ণ চোরাচালান

আপডেট সময়ঃ ০৫:৪৪:৩৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ৭ মে ২০২৫

দেশে স্বর্ণের চোরাচালান ঠেকানো যেন অসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বন্দরগুলোতে কয়েক স্তরের স্ক্যানার, বিভিন্ন সংস্থার গোয়েন্দা নজরদারি ও ডিজিটাল ম্যানুয়াল যাচাইয়ের পরও দেশের বাজারে দেদার ঢুকছে স্বর্ণের চোরাচালান। অন্যদিকে এসব স্বর্ণ আনতে বর্তমানে এমন আজব সব কৌশল প্রয়োগ হচ্ছে, যেগুলো ধরতেও ঘাম ছুটে যাচ্ছে গোয়েন্দাদের।

বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) তথ্যমতে, গত বছর দেশের জল, স্থল ও আকাশপথে প্রায় ৯১ হাজার ২৫০ কোটি টাকার চোরাই স্বর্ণ, অলংকার বাংলাদেশে ঢুকেছে। এতে প্রশ্ন উঠেছে, এতগুলো ধাপ পেরিয়েও কীভাবে এই বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ ঢুকছে। তাহলে কি রক্ষকই ভক্ষকের ভূমিকায় আছে।

একাধিক সংস্থার দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলেছেন, বিমানবন্দর টার্মিনালে স্ক্যানের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি, উড়োজাহাজের পাইলট, কেবিন ক্রুসহ ফ্লাইট পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এই স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। অভ্যন্তরে কাজ করা একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী চোরাকারবারি চক্রের সদস্য। তা না হলে এমন সুরক্ষিত কয়েকটি ধাপ পেরিয়ে স্বর্ণ আনা-নেওয়া করা সম্ভব নয়। ফলে স্বর্ণের চোরাচালান ধরতে আগে ‘সর্ষের মধ্যের ভূত’ তাড়াতে হবে।

স্বর্ণ চোলাচালানের অভিনব এই কৌশল দেখে শুধু কাস্টমস কর্মকর্তারাই নন; চোখ কপালে উঠছে সিআইডি, শুল্ক গোয়েন্দা, এপিবিএনসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সদস্যদের। ঢাকা কাস্টম হাউসের যুগ্ম কমিশনার সুমন দাসের মতে, নতুন-পুরোনো এমন অন্তত অর্ধশতাধিক কৌশল বের করেছেন স্বর্ণ চোরাকারবারিরা; যাদের চিহ্নিত করতে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোকে। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, একদিকে স্বর্ণ চোরাচালান যেমন বাড়ছে, তেমনি স্বর্ণ বহনেও দেখা যাচ্ছে আজব সব কৌশল। যদিও কারবারিদের দমাতে সতর্ক রয়েছে কাস্টমস, কাস্টমস গোয়েন্দাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

এমনই একটি অভিনব কৌশল ধরা পড়ে গত ২৫ এপ্রিল বেলা সোয়া ১১টার দিকে। এদিন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে দুবাই থেকে সিলেট হয়ে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন ৩৮ বছর বয়সী শাহজাহান। কাস্টমস কর্মকর্তাদের কাছে সন্দেহজনক হওয়ায় ওই যাত্রীর পোশাক খুলে হাতে নেওয়া হলে ‘অস্বাভাবিক ওজন’ মনে হয়। পরে তার চারটি ‘আন্ডারওয়্যার’ একটি ফুল প্যান্ট ও তিনটি টি-শার্ট আগুনে পুড়িয়ে ডাস্টসহ ২ হাজার ৫৬০ গ্রাম স্বর্ণের পাউডার উদ্ধার করে কাস্টমস। পরে পরিশোধন করে ২ কেজি ৪১৭ গ্রাম স্বর্ণ পাওয়া যায়। জব্দ করা ওই স্বর্ণের আনুমানিক মূল্য প্রায় ৫ কোটি টাকা। পোশাকে ভরে আনা আড়াই কেজি স্বর্ণ বহনের জন্য ওই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে বিমানবন্দর থানায় মামলা করা হয়েছে।

বিমানবন্দরগুলোতে কাজ করা কর্মকর্তারা বলেছেন, নতুন-পুরোনো মিলে অর্ধশতাধিক কৌশলে কারবারিরা দেশে স্বর্ণের চালান নিয়ে আসছে। খুব সহজে যাতে শনাক্ত করা না যায়, সে জন্য স্বর্ণের বারের ওপর কালো ও সিলভারের প্রলেপ দেওয়া হচ্ছে। এই কাজে ফ্লাইট বা উড়োজাহাজের পাইলট, কেবিন ক্রু, ইঞ্জিনিয়ার, ট্রলিম্যান, ক্লিনার ও মালপত্র স্ক্যানের দায়িত্বে যারা রয়েছেন তাদের অনেকে চক্রের হয়ে কাজ করছেন।

সম্প্রতি যেসব কৌশল ধরা পড়েছে তার মধ্যে রয়েছে- জুতা, বেল্ট, কোমরবন্ধনী, শার্টের কলার, স্যান্ডেল, সাবান কেস, সাউন্ড বক্স, আন্ডারওয়্যারের ভেতর বিশেষ কায়দায় স্বর্ণ বহন। পাশাপাশি মানিব্যাগ, গলায় স্বর্ণের চেইনের সঙ্গে লকেট হিসেবে ঝুলিয়েও স্বর্ণের বার আনা হচ্ছে। এ ছাড়া হুইলচেয়ারে রোগী সেজে, ওষুধের কৌটা ও বিভিন্ন ধরনের খাবারের প্যাকেটেও চোরাই স্বর্ণ আনা হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা কাস্টম হাউসের যুগ্ম কমিশনার সুমন দাস বলেন, ‘স্বর্ণ চোরাচালান বাড়ার পাশাপাশি কৌশলও পরিবর্তন করছেন কারবারিরা। এ বিষয়ে ঢাকা কাস্টম হাউসসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সতর্ক রয়েছেন। প্রতিটি শিফটে তদারকি ও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া নতুন কৌশলে দুই বা তিন কেজির চালান আনলেও সেগুলো ধরা হচ্ছে। চোরাকারবারিরা নিত্যনতুন কৌশল ব্যবহার করলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সতর্ক রয়েছেন।’

গত ১২ মার্চ চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সৌদি আরবের জেদ্দা থেকে আসা এক যাত্রীর কাছ থেকে ১২টি ২২ ক্যারেট স্বর্ণের চুড়ি জব্দ করা হয়, যার বাজারমূল্য প্রায় ৫০ লাখ ৬৯ হাজার ২০০ টাকা। এর আগে গত ৮ ফেব্রুয়ারি কুয়েত থেকে আসা জাজিরা এয়ারলাইনসের একটি বিমানের এক যাত্রীর কাছ থেকে দুই কেজি স্বর্ণ ও ১৪ ফেব্রুয়ারি সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফ্লাইটের সিটের নিচে লুকানো আটটি স্বর্ণের বার জব্দ করা হয়। একই মাসের ১৫ তারিখ সৌদি আরবে ওমরাহ পালন শেষে দেশে ফেরা এক যাত্রীর কাছ থেকে একটি ব্লেন্ডার মেশিনে লুকানো তিন কেজি ও ১৭ তারিখ সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দরে ফ্যানের ভেতরে করে আনা ১৭ কেজি স্বর্ণ জব্দ করা হয়।

এ ছাড়া গত বছরের ৩ ডিসেম্বর মালয়েশিয়া থেকে আসা পাঁচ যাত্রীর কাছ থেকে প্রায় সাত কেজি স্বর্ণ ও ২৭ ডিসেম্বর শাহ আমানত বিমানবন্দরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটের ভেতর থেকে ২০টি স্বর্ণের বার জব্দ করা হয়। সর্বশেষ গত রবিবার দিবাগত রাতে শাহজালাল বিমানবন্দরে স্বর্ণালঙ্কার তৈরির মেশিনের ভেতর থেকে ১ কেজি ২০০ গ্রাম স্বর্ণ জব্দ করা হয়।

নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো জানাচ্ছে, হযরত শাহজালাল, শাহ আমানত এবং ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে ব্যবহার করে নতুন নতুন কৌশলে দেশে স্বর্ণ আনছে মধ্যপ্রাচ্য ও দুবাইভিত্তিক একটি চক্র। শুল্ক ফাঁকি দিতে এমন তৎপরতা আগে এত বেশি চোখে পড়েনি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। একাধিক কাস্টমস কর্মকর্তা জানান, আগে স্বর্ণ আনতে লাগেজ ও শরীর ব্যবহার করা হতো। কিন্তু এখন রোগী সেজে, স্বর্ণ গুঁড়া করে সেগুলো অন্য কোনো পদার্থ উল্লেখ করে পার হওয়ার চেষ্টা চলছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা (ডিআইজি) বলেন, ‘উড়োজাহাজে ওঠার আগে প্রবেশ গেটে শরীর, লাগেজ ও মালপত্র স্ক্যানার মেশিনের মাধ্যমে চেক করে প্রবেশ করানো হয়। সেখানে একটি আলপিনও চোখ ফাঁকি দিয়ে ঢোকানো সম্ভব নয়। কিন্তু আমরা দেখছি, ওজনে বিপুল পরিমাণ বা কোটি কোটি টাকার স্বর্ণ জব্দ করা হচ্ছে। এখানে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে এই স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে স্ক্যানের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি, উড়োজাহাজের পাইলট, কেবিন ক্রুসহ অভ্যন্তরে কাজ করা একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত। তাদের সহযোগিতা ছাড়া এভাবে স্বর্ণ আনা সম্ভব নয়।’

সিআইডির ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, বিমানবন্দরে শিফটিং ডিউটি থাকে। অনেক সময় চক্রের কেউ উপস্থিত না থাকলে সেগুলোই সাধারণত ধরা পড়ে। যে পরিমাণ স্বর্ণের চোরাচালান প্রতিদিন আসে, তার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ নানাভাবে ধরা পড়ে। অন্যদিকে চালানসহ যারা ধরা পড়েন তারা মূলত বাহক। বাহক বা ক্যারিয়ারকে ধরে চোরাচালান প্রতিরোধ করা কঠিন। চোরাচালান ধরতে ‘সর্ষের মধ্যে ভূত’ বলে যে প্রবাদ আছে আগে সেই ভূত তাড়াতে হবে।

বাজুসের তথ্যমতে, গত বছর দেশের জল, স্থল ও আকাশপথে প্রতিদিন গড়ে কমপক্ষে ২৫০ কোটি টাকার অবৈধ স্বর্ণের অলংকার, স্বর্ণের বার, ব্যবহৃত পুরোনো জুয়েলারি (যা ভাঙারি হিসেবে বিবেচিত হয়) ও হীরার অলংকার (ডায়মন্ড জুয়েলারি) চোরাচালানের মাধ্যমে বাংলাদেশে আসে, বছর শেষে যার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৯১ হাজার ২৫০ কোটি টাকার বেশি। পুরো এই টাকা হুন্ডির মাধ্যমে চোরাকারবারিরা বিদেশে পাচার করে থাকে বলে জানায় বাজুস।

এ প্রসঙ্গে বাজুসের সহসভাপতি মাসুদুর রহমান বলেন, দেশের জল, স্থল ও আকাশপথ ব্যবহার করে বছরে ৯১ হাজার ২৫০ কোটি টাকার স্বর্ণ ঢুকছে দেশে, তা আবার ডলার হয়ে চলে যাচ্ছে বাইরের দেশে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন দেশের বৈধ বা অনুমোদিত ব্যবসায়ীরা। তিনি বলেন, স্বর্ণ চোরাচালান কমাতে হলে সরকারের এই ব্যবসার শুল্ক কমাতে হবে ও সহজ শর্তে স্বর্ণ আনার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। বিমানবন্দরে ওয়ান স্টপ সেন্টারের পাশাপাশি পরীক্ষা-নীরিক্ষা শেষে ২ ঘণ্টার মধ্যে ছেড়ে দিতে হবে। শুল্ক কমালে চোরাচালান কমে আসবে, যা ব্যবসায়ী ও দেশের জন্য মঙ্গলজনক বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

এ বিষয়ে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) সৈয়দ মুশফিকুর রহমান বলেন, ‘স্বর্ণ চোরাকারবারিদের দমাতে গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ও সোর্স বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), কাস্টম হাউসসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর দায়িত্বশীলদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করা হচ্ছে। পাশাপাশি ‘কাস্টমস বিটে’ নিজস্ব টিমও কাজ করছে।’ তিনি জানান, চোরাচালানের নতুন কৌশল ধরতে গোয়েন্দারাও বিভিন্ন ধরনের পক্ষক্ষেপ নিচ্ছেন। এ কারণে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে চোরাচালানও ধরা পড়ছে।

নিউজটি শেয়ার করুন