১৮ আগস্ট ঐতিহাসিক নানকার দিবস। বাঙালি জাতির সংগ্রামের ইতিহাসে বিশেষ করে অধিকারহীন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যে সকল গৌরব মণ্ডিত আন্দোলন বিদ্রোহ সংগঠিত হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম প্রধান হলো ‘নানকার বিদ্রোহ’।
‘নান’ শব্দের অর্থ ‘রুটি’। এই নান শব্দ থেকেই নানকার শব্দের উৎপত্তি। নানকার শব্দের অর্থ রুটি দিয়ে কেনা গোলাম।
ব্রিটিশ সম্রাজ্যের আমলে সামন্তবাদী ব্যবস্থার সবচেয়ে নিকৃষ্টতম শোষণ পদ্ধতি ছিল নানকার প্রথা। নানকার প্রজারা জমিদারের দেওয়া বাড়ি ও সামান্য কৃষি জমি ভোগ করত। কিন্তু ওই জমি ও বাড়ির উপর তাদের কোনো মালিকানা ছিল না। নানকার প্রজারা বিনা মজুরিতে জমিদারের বাড়িতে কাজ করতেন। চুন থেকে পান খসলেই তাদের উপর চলত অকথ্য নির্যাতন। নানকার প্রজার জীবন শ্রম ও শক্তির উপর যেমন ছিল জমিদারদের সীমাহীন অধিকার তেমনি নানকার নারীদেরও তারা ভোগের পণ্য হিসাবে ব্যবহার করত।
নানকার প্রজারা এই অসহনীয় অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে থাকে এবং ধীরে ধীরে আন্দোলনের পথে অগ্রসর হয়। নানকার প্রথা মূলত বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলে বিশেষ করে সিলেট জেলায় চালু ছিল।
নানকার বিদ্রোহের প্রধান সংগঠক কমরেড অজয় ভট্টাচার্যের দেওয়া তথ্যমতে সেসময়ে বৃহত্তর সিলেট জেলায় ৩০ লাখ জনসংখ্যার ১০ ভাগ ছিল নানকার।
১৯২২ সাল থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত কমিউনিষ্ট পার্টি ও কৃষক সমিতির সহযোগিতায় সিলেটের বিয়ানীবাজার গোলাপগঞ্জ, বড়লেখা, কুলাউড়া, বালাগঞ্জ, ধর্মপাশা থানার অনেকে নানকার আন্দোলনে অংশ নেয়। নানকার বিদ্রোহের কেন্দ্রভূমি হল বিয়ানীবাজার থানার শানেশ্বর এলাকা।
লাউতা ও বাহাদুর পুরের জমিদারদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে নানকাররা জমিদারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। কমরেড অজয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে নানকাররা সংগঠিত হলে নানকার আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠে।
১৯৪৭ সালে নানকার আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন পাকিস্তান সরকার এই আন্দোলন নস্যাত করতে চায়। মুসলিম লীগ সরকার ও জমিদাররা নানকারদের উপর জুলুম নিপিড়নের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ষড়যন্ত্র করে হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টি করতে চায়।
১৯৪৯ সালের ১৫ আগস্ট নানকাররা কৃষক সমিতি ও কমিউনিষ্ট পার্টির সাহায্যে পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস পালন করে। কিন্তু বিষয়টিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে জমিদাররা পাকিস্তান সরকার ও মুসলমানদের কাছে প্রচার করে যে ১৫ আগস্ট শানেশ্বরে হিন্দু দিবস ও ভারতের স্বাধীনতা দিবস পালন হয়েছে। সাথে সাথে পাকিস্তান সরকার সে এলাকায় পুলিশ ও ইপিআর পাঠিয়ে বিদ্রোহীদের দমনের নির্দেশ দেয়।
১৯৪৯ এর ১৮ আগস্ট সূর্য উঠার পূর্বেই তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকারের পুলিশ, ইপিআর ও জমিদারদের নিজস্ব পেটোয়া বাহিনী হামলা চালায় শানেশ্বর গ্রামের নানকারদের উপর। শানেশ্বর ও পার্শবর্তী উলুউরী গ্রামের নানকাররা ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশীও অস্ত্র নিয়ে শানেশ্বর ও উলুউরী গ্রামের মধ্যবর্তী সুনাই নদীর তীরে বাহিনীর মুখোমুখী হয়।জন্ম নেয় এক নির্মম ইতিহাস। রক্তে রঞ্জিত হয় শানেশ্বরের মাটি আর সুনাই নদীর জল।
রণেক্ষেত্রেই নিহত হন ব্রজনাথ দাস (৫০), কুটু মনি দাস (৪৭), প্রসন্ন কুমার দাস (৫০), পবিত্র কুমার দাস (৫০) ও রজনী দাস (৫০)। আহত অমূল্য কুমার দাস (১৭) পরবর্তী সময়ে বন্দি অবস্থায় শহীদ হন। সশস্ত্র বাহিনীর নির্মম নির্যাতনে নানকার আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী অন্তঃসত্ত্বা অর্পনা পাল চৌধুরীর ঘটনাস্থলেই গর্ভপাত ঘটে।
১৯৩৭ সালের নানকার প্রথার বিরুদ্ধে প্রথম যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তার রক্তাক্ত পরিসমাপ্তি ঘটে শানেশ্বর গ্রামে এসে। ১৯৪৯ এর ১৮ আগস্ট ৬ জন কৃষক তাদের বুকের তাজা রক্তে পূর্বসূরীদের ঋণ শোধ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫০ সালে সরকার জমিদারী প্রথা বাতিল করেন নানকার প্রথা রদ করে কৃষকদের জমির মালিকানার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।
বিদ্রোহের ৫৮ বছর অতিবাহিত হলেও নানকার আন্দোলনে বীর শহীদদের স্মৃতিরার্থে কোনো স্মৃতিসৌধ নির্মাণ হয়নি এখনও। তবুও প্রতি বছরই মুক্তিযোদ্ধা সাংস্কৃতিক কমাণ্ড বিয়ানীবাজার, উলুউরী উন্নয়ন মুখী যুবসংঘ ও শানেশ্বর এলাকাবাসী এই দিনে অস্থায়ী সৌধ নির্মাণ করে শ্রদ্ধা জানায় নানকার আন্দোলনের শহীদের প্রতি।
তাদের এ আত্মত্যাগের ফলেই ১৯৫০ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার জমিদারি ব্যবস্থা বাতিল ও নানকার প্রথা রদ করে কৃষকদের জমির মালিকানার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। তাই বাঙালি জাতির সংগ্রামের ইতিহাসে বিশেষ করে অধিকার হীন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যে সকল গৌরবমণ্ডিত আন্দোলন বিদ্রোহ সংগঠিত হয়েছিল এটি তাদের মধ্যে অন্যতম। প্রতিবছর বিয়ানীবাজারে এই দিবসটি পালন হয় যথাযোগ্য মর্যাদায়।
প্রধান সম্পাদকঃ আবুবকর সিদ্দিক সুমন। নির্বাহী সম্পাদকঃ রুবেল হাসনাইন। বার্তা সম্পাদকঃ রুমি বরুয়া।
গুলশান, ঢাকা-১২১৬, বাংলাদেশ। ইমেইলঃ admin@sylhet21.com,sylhet21.com@gmail.com মোবাইলঃ +1586 665 4225
©২০২৫ সিলেট ২১ সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত। | Developed Success Life IT