আলোচিত ‘সান্ডা’ আসলে কী?

- আপডেট সময়ঃ ১২:২৪:৫১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৮ মে ২০২৫
- / ৫৭ বার পড়া হয়েছে।

সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যে বসবাসরত এক প্রবাসী বাংলাদেশির ‘সান্ডা’ নামক এক প্রকারের সরীসৃপ প্রাণী ধরার ও খাওয়ার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ভিডিওতে তাকে মরু অঞ্চলের এই প্রাণীটি নিয়ে ব্যতিক্রমধর্মী অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে দেখা যায়, যা নেটিজেনদের দৃষ্টি কাড়ে।
ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই ফেসবুক, টিকটক ও ইউটিউবসহ বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে সান্ডা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা ও হাস্যরস। তৈরি হয়েছে অসংখ্য মজার মিম, কৌতুক ও ব্যঙ্গচিত্র।
এই আলোচনার সূত্র ধরে সান্ডা ও এর তেল সম্পর্কেও নতুন করে আগ্রহ তৈরি হয়েছে নেটিজেনদের মাঝে।
আসলে ‘সান্ডা’ কী?
‘সান্ডা’ নামটি মূলত একটি নির্দিষ্ট প্রাণীকে নির্দেশ করে না। এটি স্পাইনি টেইলড লিজার্ড বা কাঁটাযুক্ত লেজওয়ালা টিকটিকির একটি সাধারণ নাম, যার বৈজ্ঞানিক নাম ইউরোমাস্টিক্স (Uromastyx)। এই প্রজাতিটি অ্যাগামিডি (Agamidae) গোত্রের অন্তর্গত এবং এর অন্তত এক ডজনের বেশি প্রজাতি রয়েছে। মূলত মরু ও আধা-মরু অঞ্চলে বাস করা এসব টিকটিকিকে সাধারণভাবে ‘সান্ডা’ বলা হয়ে থাকে। আরবি ভাষায় এদের ডাকা হয় ‘দব’ নামে।
এই লিজার্ডরা আফ্রিকার উত্তরাঞ্চল থেকে শুরু করে ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত শুষ্ক ও উষর অঞ্চলে বাস করে। সৌদি আরবের বিশাল মরুভূমি হচ্ছে এদের অন্যতম প্রাকৃতিক আবাসস্থল। দিনের বেলায় এরা সূর্যস্নানে মগ্ন থাকে আর সন্ধ্যা হলেই নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে গর্তে ঢুকে পড়ে। বিপদের সময় দ্রুত পাথরের খাঁজে আশ্রয় নেয় এবং সেখান থেকেই গাছের পাতা ও ফলমূল খায়। মাঝে মাঝে ছোট পোকামাকড়কেও এরা খাবার হিসেবে গ্রহণ করে।
গিরগিটির মতো আশপাশের তাপমাত্রা ও ঋতুভেদে এরা রঙ বদলাতে পারে। প্রাণীটি ঠান্ডায় গাঢ় রঙ ধারণ করে, যাতে সূর্যের তাপ সহজে শোষণ করতে পারে; আর গরমে রঙ হয় হালকা, যাতে শরীর অতিরিক্ত উত্তপ্ত না হয়। এইভাবেই শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে বেঁচে থাকে।
সান্ডার মাথা চওড়া, শরীর মোটা ও চারটি পা বিশিষ্ট। বড়দের গড় দৈর্ঘ্য প্রায় ২৫ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার (১০ থেকে ১২ ইঞ্চি)। এদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো মোটা ও কাঁটাযুক্ত লেজ, যা আত্মরক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়। বিপদের সময় গর্তে ঢুকে লেজটি বাইরে বের করে হিংস্রভাবে দোলাতে থাকে, যাতে শিকারি ভয় পেয়ে পালায়। সব প্রজাতির সান্ডা ডিম পাড়ে এবং প্রাপ্তবয়স্ক হলে এরা নিরামিষভোজী হয়।
কারা সান্ডা খায়?
মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমির বেদুঈন বা স্থানীয় গোষ্ঠীর কিছু মানুষ সান্ডা শিকার এবং খেয়ে থাকেন। কেউ কেউ সান্ডার বিরিয়ানিও রান্না করেন।
ভারত ও পাকিস্তানে স্থানীয় কিছু জনগোষ্ঠীও সান্ডা শিকার করেন। মুরগীর মাংসের মতো সান্ডার সাদা মাংসের স্বাদ বিবেচিত হয় এবং কিছু হিন্দু জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে এটি একটি সুস্বাদু খাবার। বিশেষ করে লেজের অংশটি খাবারের অন্যতম আগ্রহের কেন্দ্র।
প্রাকৃতিক পরিবেশে সান্ডা বিভিন্ন শিকারী পাখি যেমন, লাগর বাজ ও টনি ঈগলের খাদ্য। মরুভূমির শিয়াল ও সাপরাও এদের গর্তে হানা দেয়।
ইসলামে সান্ডার মাংস খাওয়ার বিধান কী?
নবী করিম (সা.)-এর সামনে একবার তার সাহাবীরা সান্ডা পরিবেশন করেন। তখন তিনি সেটি খাননি। সে সময় তার সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি কি এটি খেতে অপছন্দ করেন, এটি হারাম?’
এই প্রশ্নের উত্তরে নবী করিম (সা.) বললেন- ‘এটি আমার কওমের খাদ্য নয়, তাই আমি খাই না।’ (সহীহ বুখারী: ৫৫৩৭, সহীহ মুসলিম: ১৯৪৪)
অর্থাৎ, এটি তিনি নিজে না খেলেও সাহাবীদের খেতে মানা করেননি। এমনকি সাহাবীরা তার সামনে এটি খেয়েছেন।
ফিকহবিদগণ এই সকল হাদীসগুলো বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন ধর্মে সান্ডা খাওয়ার হুকুম নির্ধারণ করেছেন। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বলেছেন- সান্ডা খাওয়া মাকরূহ তাহরিমি। এর অর্থ, এটি না খাওয়াই উত্তম। কারণ এটা অরুচিকর একটি প্রাণী যা মানুষ সাধারণত খেতে চায় না। শাফেয়ি, মালিকি ও হাম্বলি মাজহাবের আলেমদের মতে, সান্ডা খাওয়া পুরোপুরি হালাল।
সান্ডা তেল কি সত্যিই উপকারি?
সান্ডা নিয়ে জনপ্রিয় একটি বিশ্বাস হলো এর তেল, যাকে বলা হয় ‘সান্ডা তেল’। অনেক আয়ুর্বেদিক ও হেকিমি চিকিৎসায় এটি ব্যবহারের কথা বলা হয়, বিশেষ করে যৌন শক্তি বৃদ্ধির জন্য। ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে কিছু আঞ্চলিক বাজারে এই তেল বিক্রি হয় এবং একে ‘প্রাকৃতিক উত্তেজক’ হিসেবে প্রচার করা হয়। এছাড়া শরীরের পেশীর ব্যথার জন্য এটিও ব্যবহার করা হয়। পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডির রাজা বাজারে এই তেল বিক্রি হয় এবং ‘স্ট্যামিনা বুস্টার’ হিসেবে বাজারজাত করা হয়।
তবে বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এর কার্যকারিতা এখনও প্রমাণিত নয়। আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যা বা প্রামাণ্য গবেষণায় এখনো সান্ডা তেলের উপকারিতা বা নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়নি। বরং অজ্ঞাত উৎস থেকে তৈরি এসব তেল শরীরের জন্য ক্ষতিকরও হতে পারে। এতে ত্বকের জ্বালা, অ্যালার্জি বা অন্যান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
সান্ডার পরিচিতিই বিলুপ্তির কারণ
অতিরিক্ত শিকার ও আবাস্থল ধ্বংসের কারণে বর্তমানে সান্ডা বিলুপ্তির হুমকিতে রয়েছে। ইউটিউবসহ বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে সান্ডা তেলের অবৈধ ব্যবসা প্রসার লাভ করেছে এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে।
সান্ডা তেলের বৈশ্বিক বাজার কয়েক বিলিয়ন ডলারের বলে ধারণা করা হয়, যা প্রাণীটিকে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।
এই চাহিদা একে অতিরিক্ত শিকারের দিকে ঠেলে দিয়েছে। বর্তমানে রাজস্থানের পশ্চিমাঞ্চলে এই প্রজাতি বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সান্ডা জাতীয় প্রাণীকে ‘বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
সৌদি আরবে ধাব বা সান্ডা প্রজাতির প্রাণীর শিকার নিয়ন্ত্রিত। অনুমতি ছাড়া এমন প্রজাতির বাণিজ্য করলে ৩ কোটি সৌদি রিয়াল পর্যন্ত জরিমানা বা ১০ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।
ভারতে প্রাণীটিকে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন, ১৯৭২-এর প্রথম তফসিলে রাখা হয়েছে, যা সর্বোচ্চ সুরক্ষা প্রদানের নিশ্চয়তার কথা বলে।
পাকিস্তানেও সুরক্ষার আইন থাকলেও অবৈধ শিকার ও সান্ডা তেলের বাজারের কারণে বাস্তবে হুমকি থেকেই যাচ্ছে।
শিকার নিয়ন্ত্রণ, বাসস্থান রক্ষা, এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এই গুরুত্বপূর্ণ মরুভূমির প্রাণীটির টিকে থাকার জন্য এখনই সংরক্ষণমূলক পদক্ষেপ জরুরি।