
অন্তর্বর্তী সরকারের সাবেক দুই উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াকে জোটের প্রার্থী করতে রাজি নয় জামায়াতে ইসলামী। দলটির বক্তব্য– প্রার্থী করলে দুই উপদেষ্টার ‘বিতর্কিত’ কাজের দায় পড়বে জামায়াত-এনসিপি জোটের ওপর। আবার এ জোটকে সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট হিসেবে চিত্রিত করে প্রতিদ্বন্দ্বীরা ভোটের প্রচারে সমালোচনা করবে।
জামায়াত-এনসিপির সম্ভাব্য জোটের আলোচনায় দায়িত্ব পাওয়া নেতারা সমকালকে এসব তথ্য জানিয়েছেন। সূত্র জানায়, দুই সাবেক উপদেষ্টাকে ছাড়া জোটে আসতে চায় না এনসিপি। মাহফুজ ও আসিফ দলীয় অবস্থান ও প্রার্থিতা নিশ্চিত করা ছাড়া জামায়াতের সঙ্গে জোটে যেতে রাজি নন। তাদের অনুসারীরা সরাসরি জোটের বিরোধিতা করছেন। তারা বিএনপির সঙ্গে জোট চান। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করতে চান। তবে এনসিপিকে সপ্তাহখানেক আগে চারটি আসন ছাড়ার প্রস্তাব করা বিএনপি এখন আর আলোচনায় আগ্রহ দেখাচ্ছে না।
গত বুধবার এনসিপির নির্বাহী পরিষদের বৈঠকে উপস্থিত ৯০ শতাংশ সদস্য জামায়াতের সঙ্গে জোটের প্রস্তাব করেন। এ প্রস্তাবের লিখিত কার্যবিবরণী তৈরির পর জামায়াত আমিরের সঙ্গে এনসিপির নেতারা বৈঠকে বসেন। এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এবং সদস্য সচিব আখতার হোসেন আসন বণ্টনের আলোচনা চালাচ্ছেন। তাদের বক্তব্য জানতে পারেনি সমকাল। অন্য নেতাদের আসন বণ্টন বিষয়ে গণমাধ্যমে কথা বলতে নিষেধ করেছে এনসিপি।
এনসিপি সূত্র জানায়, দলের শীর্ষ ১০ নেতার মধ্যে জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্থা শারমিন, জেষ্ঠ্য সদস্য সচিব নাহিদ সারোয়ার নেভাসহ পাঁচ নেত্রী ধর্মভিত্তিক দল জামায়াতের সঙ্গে জোটের বিরুদ্ধে। তাদের ক্ষোভ প্রশমন করার চেষ্টা চলছে। তাদের কয়েকজনকে জোটের প্রার্থী করা হবে বলে আলোচনা আছে।
দুই সাবেক উপদেষ্টায় জামায়াতের আপত্তি
আসন বণ্টন আলোচনার দায়িত্বে থাকা জামায়াত নেতারা বলেছেন, একজন সাবেক উপদেষ্টার বিরুদ্ধে দুর্নীতির নানা অভিযোগ উঠেছে। সেগুলো সত্য-মিথ্যা যাই হোক, তাঁকে জোটের প্রার্থী করলে দায় নিতে হবে। আরেকজন উপদেষ্টা থাকাকালে মওদুদীর মতবাদসহ নানা বিষয়ে জামায়াতকে লাগাতার আক্রমণ করেছেন। তাঁকে প্রার্থী করলে দলীয় নেতাকর্মীদের কাছে খারাপ বার্তা যাবে।
জামায়াত নেতাদের মূল্যায়ন, দুই সাবেক উপদেষ্টার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এবং প্রশাসনের সঙ্গেও দ্বন্দ্ব রয়েছে। তাদের জোটের প্রার্থী করলে এর দায় জামায়াতকে নিতে হবে। সাবেক উপদেষ্টাদের প্রার্থী করলে সরকারের মদদপুষ্ট হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পাশপাশি সরকারি শক্তির বিরোধিতার মুখে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে, যা নির্বাচনে ক্ষতি করবে।
এনসিপির গণতান্ত্রিক সংস্কার জোটের শরিক এবি পার্টিও জামায়াতের সঙ্গে আসন সমঝোতার আলোচনা চালাচ্ছে। এ দলটির এক নেতা সমকালকে বলেছেন, জামায়াত দুই সাবেক উপদেষ্টাকে প্রার্থী করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না।
মাহফুজ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট না করলেও আসিফ মাহমুদ ঢাকা-১০ আসন থেকে মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন। তিনি বিএনপি সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। বিএনপি এতে রাজি হয়নি বলে জানা গেছে। এনসিপির এক জ্যেষ্ঠ নেতা সমকালকে বলেন, আসিফ দলে আসতে এবং জামায়াত জোটের প্রার্থী হতে প্রস্তুত। বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর তিনি ঘোষণা দেবেন। মাহফুজও এনসিপিতে যোগ দেবেন।
এনসিপির জোটের আরেক শরিক রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন জানিয়েছে, জামায়াতের সঙ্গে জোটের আলোচনার বিষয় আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি। রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সভাপতি হাসনাত কাইয়ূম বলেন, ‘খবরটি সত্য হয়ে থাকলে এনসিপি ও এবি পার্টি জোটের আকাঙ্ক্ষা মানছে না। এটা তারা করতে পারে না।’
৩০ আসন ধরে আলোচনা, তবে বেশি প্রার্থী দিতে চায় এনসিপি
জামায়াতের কাছে এনসিপি ও এবি পার্টি ৫০ আসন চেয়েছে। তবে জামায়াত ৩০ আসন নিয়ে আলোচনা করছে। দলটি শর্ত দিয়েছে, যেসব আসন ছেড়ে দেওয়া হবে সেগুলোর বাইরে এনসিপি প্রার্থী দিতে পারবে না। তবে এনসিপি চায়, ৩০ আসন ছাড়লেও আর ১০-২০টিতে শাপলা কলির প্রার্থী থাকবে। দলটির এই প্রার্থীরা জামায়াতের জোটের প্রার্থীর বিরুদ্ধে লড়বে। তবে জামায়াত এতে রাজি হয়নি। দলটির একজন জ্যেষ্ঠ নেতা সমকালকে বলেছেন, ৩০০ আসনে জোটের ৩০০ প্রার্থী থাকবেন। এনসিপি বাড়তি প্রার্থী দিলে অন্য দলও দেবে। তখন আর জোট থাকবে না।
তবে এনসিপির নেতারা বলছেন, বাড়তি প্রার্থী দিতে না পারলে দলে ভাঙন দেখা দেবে। এনসিপির একজন নেতা সমকালকে বলেন, চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলনের চেয়ে অন্তত পাঁচটি আসন বেশি দিতে হবে এনসিপিকে। জোটে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে এনসিপি থাকবে। এ শর্তেই জামায়াতের সঙ্গে আলোচনা চলছে।
ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে টানাপোড়েন
জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতার আলোচনায় প্রথমে ১৫০ আসন চেয়েছিল চরমোনাইর পীরের দল ইসলামী আন্দোলন। পরে দলটি ১২০ আসন দাবি করে। সবশেষ অবস্থান হলো– ১০০ আসন ছাড়তে হবে। মামুনুল হকের বাংলাদেশ খেলাফত ৫০ আসন চেয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এ দাবি ৩৫ আসনে ঠেকেছিল। এনসিপি জোটে এলে খেলাফত আরও ছাড় দিয়ে অন্তত ২২টি আসন দাবি করেছে। তবে জামায়াত তাদের ১০-১২টির বেশি আসন ছাড়তে রাজি নয়। চরমোনাই পীরের দলকে ৩০ থেকে ৩৫টি আসন ছাড়তে চায় জামায়াত। এতে ক্ষুব্ধ ইসলামী আন্দোলন এবং বাংলাদেশ খেলাফত। গতকাল গুঞ্জন ছড়ায়, দল দুটি জোট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ খেলাফতের যুগ্ম সচিব আতাউল্লাহ আমিন আগের দিনের মতো শুক্রবারও সমকালকে বলেছেন, এই গুঞ্জনের সত্যতা নেই। আসন বণ্টনের আলোচনা চলমান।
চরমোনাই ও খেলাফতের নতুন প্রস্তাব হলো, জামায়াত ১৫০ আসনে; এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ বাকি ৯ দল ১৫০ আসনে নির্বাচন করবে। চরমোনাইর হাতপাখার প্রার্থী থাকবে ৭৫ আসনে।
দলীয় সূত্র জানায়, আট দলের শীর্ষ নেতাদের আনুষ্ঠানিক বৈঠক ডেকে এবং ওই বৈঠকে বাকিদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল জামায়াত। তবে ইসলামী আন্দোলন এবং বাংলাদেশ খেলাফত আসন বণ্টনের সুরাহা ছাড়া বৈঠকে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানায়। জামায়াতের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আজ শনিবার এ বৈঠক হতে পারে।
আট দলের অপর পাঁচ শরিক খেলাফত মজলিস, নেজামে ইসলাম পার্টি, খেলাফত আন্দোলন, জাগপা ও বিডিপিকে ১৫টি আসন দিতে চায় জামায়াত। তবে খেলাফত মজলিস একাই ১৫ আসন চায়।
এলডিপিসহ বিএনপির মিত্ররা আসছে জামায়াতের কাছে
বিএনপির কাছ থেকে আসন না পাওয়া লেবার পার্টি ইতোমধ্যে জামায়াতের সঙ্গে ভিড়েছে। বিএনপি তার সঙ্গে থাকা ১২ দলীয় জোট এবং ১১ দলীয় সমমনা জোটকে একটি করে আসনে ছাড় দিয়েছে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে দলগুলো জামায়াতের সঙ্গে ভিড়তে চাইছে। ১২ দলীয় জোটের শরিক জাপা (জাফর) নেতা আহসান হাবিব গতকাল জামায়াত নেতাদের সঙ্গে দেখা করে কুষ্টিয়া-২ আসনে সমর্থন চেয়েছেন।
কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীরবিক্রমের এলডিপির মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদ চলে গেছেন বিএনপিতে। এলডিপিকে একটি আসন ছেড়েছে বিএনপি। এতে ক্ষুব্ধ অলি জামায়াতের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। তিনি সাতটি আসন চেয়েছেন। কিন্তু জামায়াতও তাঁকে একটির বেশি আসন ছাড়তে সম্মত হয়নি। তবে জোটের বড় নেতার স্বীকৃতি দিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা অলিকে ‘বিশেষ সম্মান’ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে।
প্রধান সম্পাদক ঃ আবুবকর সিদ্দিক সুমন , নির্বাহী সম্পাদকঃ রুবেল হাসনাইন , বার্তা সম্পাদক ঃ মিসবাহ উদ্দিন
গুলশান, ঢাকা-১২১৬, বাংলাদেশ। ইমেইলঃ admin@sylhet21.com,sylhet21.com@gmail.com মোবাইলঃ +1586 665 4225