০৭:২১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫

ইসরাইলের যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করেছিলেন যে বাঙালি পাইলট

ডেস্ক নিউজ:
  • আপডেট সময়ঃ ১০:৫১:৪৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫
  • / ১১ বার পড়া হয়েছে।

সাইফুল আজম। ফাইল ছবি

১৯৬৭ সালের ৫ জুন বিকালে ইসরাইলের চারটি ফাইটার জেট (যুদ্ধবিমান) জর্ডানের মাফরাক বিমানঘাঁটিতে আক্রমণ করে। উদ্দেশ্য ছিল— ওই ছোট্ট দেশের বিমানবাহিনীকে শেষ করে দেওয়া। সেদিন মাত্র আধ ঘণ্টার মধ্যে ইসরাইলি বিমানবাহিনী মাটিতে থাকা ২০০-এরও বেশি মিশরীয় যুদ্ধবিমান ধ্বংস করে দিয়েছিল। খবর বিবিসি বাংলার।

কিন্তু জর্ডানের মাফরাক বিমানঘাঁটি ধ্বংস করার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ার আগেই ইসরাইলি বিমানবাহিনী নিজেদের দুটি যুদ্ধবিমান হারায়। এর মধ্যে একটি বিমানকে ভূপাতিত করেছিলেন যে পাইলট, তিনি এক বাঙালি। নাম তার সাইফুল আজম।

তিনি পাকিস্তান বিমানবাহিনীর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ছিলেন, পরে বাংলাদেশের বিমানবাহিনীতে যোগ দেন। সাইফুল আজম বাংলাদেশসহ একাধিক দেশের বিমানবাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন।

৫ জুন জর্ডান বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান ওড়ানোর সময় তিনি ইসরাইলি যুদ্ধবিমানকে গুলি করে ভূপাতিত করেন। এর ঠিক দুদিন পর ৭ জুন ইরাকের বিমানবাহিনীর একটা বিমান ওড়ানোর সময় আরও দুটি ইসরাইলি যুদ্ধবিমানকেও ভূপাতিত করেন তিনি।

১৯৬০ সালে পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে কমিশন পাওয়া সাইফুল আজম ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ভারতীয় বিমানবাহিনীরও একটি বিমান গুলি করে ভূপাতিত করেছিলেন।

‘দ্য গোল্ড বার্ড: পাকিস্তান অ্যান্ড ইটস এয়ারফোর্স, অবজারভেশনস অফ আ পাইলট’ বইয়ে মনসুর শাহ লিখেছেন— আমাদের (পাকিস্তানের) বিমানবাহিনীর টেকনিশিয়ানদের ৩৫ শতাংশ এবং সাইফুল আজমের মতো চমৎকার পাইলটসহ বিমানচালকদের এক-চতুর্থাংশ ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের।

পাকিস্তানের ফ্লাইট লেফটেন্যান্টের পদে থাকাকালীন ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় ভারতীয় যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করার পর তাকে পাকিস্তান সরকার সামরিক পদক ‘সিতারা-ই-জুরাত’ দিয়ে সম্মানিত করে।

এরপর ১৯৬৬ সালের শেষের দিকে তিনি জর্ডান বিমানবাহিনীর উপদেষ্টা হিসাবে নিযুক্ত হন। পরের বছর আরও একটি যুদ্ধে লড়েন তিনি। ওই যুদ্ধে একদিকে ছিল ইসরাইল, অন্যদিকে জর্ডান, মিশর, সিরিয়া ও ইরাকসহ আরব দেশগুলোর জোট।

ইসরাইল হঠাৎ মিশরীয় বিমানবাহিনীর ওপর হামলা চালানোর সূত্র ধরে যুদ্ধের শুরু হয়। মিশর হঠাৎ বড়-সড় ধাক্কা খাওয়ার পর জর্ডানের বিমানবাহিনীকেও সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল।

ইতিহাসবিদ ও সাবেক এয়ার কমোডর কায়সার তুফায়েল তার গ্রেট এয়ার ব্যাটলস অফ পাকিস্তান এয়ার ফোর্স’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে আকাশ প্রতিরক্ষার সীমিত অনুমতি পাওয়ার পর সাইফুল আজম জর্ডানের মাফরাক বিমানঘাঁটি থেকে লেফটেন্যান্ট এহসান শারদুমকে নিয়ে হান্টার বিমানে সওয়ার হয়ে উড়ান শুরু করেন। তাদের পেছনে পেছনে অন্যান্য হান্টার বিমানও উড়তে শুরু করে।

কায়সার তুফায়েল লিখেছেন, মরুভূমির ধুলাবালি ও উত্তাপের কারণে, দৃষ্টিশক্তি এক মাইলেরও কম ছিল। শত্রুর কোনো চিহ্নই দেখা যাচ্ছিল না। সাইফুল রাডারে মাফরাক বিমানঘাঁটির দিকে ইসরাইলি বিমান আসছে কিনা জানতে চাইলে, জবাব আসে ‘হ্যাঁ’। সঙ্গে সঙ্গে মাফরাকের উদ্দেশ্যে রওনা দেন সাইফুল।

জর্ডানের আশঙ্কা ছিল, মিশরের পর ইসরাইলি বিমানবাহিনী সেখানে হামলা চালাবে।

কায়সার তুফায়েল লিখেছেন, তিনি মাফরাক বিমানঘাঁটি থেকে চার মাইল দূরে চারটি বিমানকে কম উচ্চতায় যুদ্ধবিন্যাসে উড়তে দেখেন। অনুমান করেন যে এটা ইসরাইলি মিস্টেয়ার বিমান।

কায়সার তুফায়েল লিখেছেন, ‘ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সাইফুল আজম দেখলেন দুটো মিস্টেয়ার বিমান পূর্ণ গতিতে পশ্চিম দিকে যাচ্ছে। সাইফুল তাকে ধাওয়া করতে করতেই এহসান তার ডান দিকে আরেকটি শত্রু বিমানকে লক্ষ্য করেন। তিনি এহসানকে একটা শত্রু বিমানকে ধাওয়া করার নির্দেশ দেন আর নিজে অন্য দুটো শত্রু বিমানের পেছনে ধাওয়া করেন।’

‘সাইফুল একটা মিস্টেয়ারের পেছনে চলে আসেন, যে বিমানটি দ্রুত সমারসল্ট করে পালানোর চেষ্টা করছিল। সাইফুল ওই বিমানকে লক্ষ্য করে চারবার গুলি ছুড়লেও তার কোনোটাই লক্ষ্যে লাগেনি।’

কায়সার তুফায়েল লিখেছেন, ‘তিনি কিছুটা হতাশ হয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু হঠাৎই লক্ষ্য করেন যে শত্রু বিমান সোজা উড়তে শুরু করেছে। ব্যবধান কমিয়ে পঞ্চমবার নিশানা করেন সাইফুল। এবার মিস্টেয়ারের ডান দিক থেকে ধোঁয়া বেরোতে শুরু করে। অর্থাৎ গুলি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত লেগেছে।’

‘ওই বিমানটা কাত হয়ে যায়, কিন্তু পুরো ধ্বংস হয়েছে কিনা তা দেখতে পাননি সাইফুল। কারণ ততক্ষণে অন্য একটি ইসরাইলি বিমান তাকে আক্রমণ করার জন্য ঘুরছিল।’

কায়সার তুফায়েল আরও লিখেছেন, ‘জ্বালানি ও গোলাবারুদের অভাবে সাইফুল পিছু হটার সিদ্ধান্ত নেন এবং মাফরাকে ফিরে আসেন। তার আশঙ্কা ছিল, মাফরাকের রানওয়ে হয়তো কাজ করার মতো অবস্থাতে নেই। তাই তিনি সব বিমানকে এয়ারফিল্ডের উত্তরে অপেক্ষা করার নির্দেশ দেন। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তাদের রানওয়েতে অবতরণের অনুমতি দেওয়া হয়।’

‘কিন্তু এহসান বিপদ বুঝতে পেরে রেডিওতে নিয়ন্ত্রকের পরিচয় এবং তার কুকুরের নামও জানতে চান, যা আসলে একটা গোয়েন্দা কোড ছিল। সেই একই সময়ে জর্ডানের নিয়ন্ত্রক রেডিওতে এসে মাফরাকে অবতরণ না করার জন্য সতর্ক করেন।’

এহসান শারদুমের উপস্থিত বুদ্ধি তাদের দুজনকেই এই বিপজ্জনক ইসরাইলি ফাঁদ থেকে রক্ষা করেছিল। প্রকৃতপক্ষে ওই রানওয়ে ততক্ষণে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল এবং অবতরণ করার জন্য অনুমতির রেডিও বার্তা আসলে একটি ফাঁদ ছিল।

‘সব বিমানকে রাজধানী আম্মানের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়, যেখানে তখনো ইসরাইলিরা হামলা চালায়নি। ভাগ্যবশত পাইলটরা হামলার কিছুক্ষণ আগে অবতরণ করে।’

‘কিন্তু তাদের বিমানগুলো রক্ষা পায়নি। অবতরণের কিছুক্ষণ পরেই আধুনিক সুপার-মিস্টিক প্লেনগুলো ডাইবার বোমা ব্যবহার করে আক্রমণ চালায়, যার ফলে রানওয়ের ব্যাপক ক্ষতি হয়।’

কায়সার তুফায়েল লিখেছেন, ৭ জুন সকালে খুবই নিচু গলায় কারও কোথায় ঘুম ভাঙে সাইফুলের। বেস কমান্ডারের বার্তা নিয়ে তার কাছে পৌঁছান ইরাকের এক তরুণ অফিসার। ওই বার্তায় জানানো হয়েছিল তিনি (বেস কমান্ডার) প্রথম ফ্লাইটের জন্য চার পাইলটকে এগিয়ে আসতে বলেছেন এবং আপনাকে নেতৃত্ব দিতে বলা হয়েছে!

এরপর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে চলে যান তিনি এবং সেখানে বিমানবাহিনীতে যোগ দেন। ২০০১ সালে ‘লিভিং ঈগল’ হিসেবে তার নাম ইন্টারন্যাশনাল হল অফ ফেম-এর অন্তর্ভুক্ত হয়।

পাকিস্তান বিমানবাহিনী ম্যাগাজিনের ‘সেকেন্ড টু নান’-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে এয়ার কমোডর মোহাম্মদ আলী লিখেছেন, সাইফুল আজম চার দেশের (পাকিস্তান, জর্ডান, ইরাক ও বাংলাদেশ) বিমানবাহিনীতে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং দুই দেশের (ভারত ও ইসরাইল) বিমান গুলি করে ভূপাতিত করেছেন।

অবসরের পর বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে পাবনা থেকে অংশ নিয়ে তিনি সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন।

বাংলাদেশের সামরিক কর্মকর্তা ও বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার শহীদুল ইনাম খান তার লেখায় উল্লেখ করেছেন, সাইফুল আজমের সাহসিকতা ইসরাইলেও প্রশংসিত হয়। ২০২০ সালের জুন মাসে তার মৃত্যুর পর প্রধান সংবাদপত্রগুলো সাইফুল আজমের বিষয়ে বিশেষ নিবন্ধ প্রকাশ করেছিল।

শহীদুল ইনাম খান লিখেছিলেন, ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে যখন একটি ইসরাইলি বিমানকে নিশানা করেছিলেন সাইফুল, তখন সরাসরি আক্রমণ করার বদলে পাশ থেকে নিশানা করেন এবং বিমানের লেজে গুলি করেন। ইসরাইলি পাইলট প্রাণে বেঁচে যান। প্যারাসুটের সাহায্যে অবতরণ করেন তিনি।

ইনাম খান লিখেছেন, পাইলট পরে জানান তিনি যখন নিচে নামছিলেন, তখন সাইফুল রোল অ্যান্ড লুপ দিয়ে তার দিকে হাত নাড়েন এবং এরপর তিনি আরেকটি ইসরাইলি বিমানকে গুলি করে ভূপাতিত করার জন্য ধেয়ে যান। সাইফুল না চাইলে ওই পাইলট বাঁচতেন না।

জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ছয় দিনের যুদ্ধ শেষ হয়, কিন্তু ততদিনে ইসরাইল গোলান মালভূমি, গাজা, সিনাই উপদ্বীপ ও পশ্চিমতীর (পূর্ব জেরুজালেমসহ) দখল করে নেয় এবং মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র পুরোপুরি বদলে দেয়। তবে এই লড়াই সাইফুল আজমের কীর্তির জন্য আজও স্মরণীয় হয়ে আছে।

নিউজটি শেয়ার করুন
ট্যাগসঃ

বিস্তারিত লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষণ করুন

আপলোডকারীর তথ্য

ইসরাইলের যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করেছিলেন যে বাঙালি পাইলট

আপডেট সময়ঃ ১০:৫১:৪৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫

১৯৬৭ সালের ৫ জুন বিকালে ইসরাইলের চারটি ফাইটার জেট (যুদ্ধবিমান) জর্ডানের মাফরাক বিমানঘাঁটিতে আক্রমণ করে। উদ্দেশ্য ছিল— ওই ছোট্ট দেশের বিমানবাহিনীকে শেষ করে দেওয়া। সেদিন মাত্র আধ ঘণ্টার মধ্যে ইসরাইলি বিমানবাহিনী মাটিতে থাকা ২০০-এরও বেশি মিশরীয় যুদ্ধবিমান ধ্বংস করে দিয়েছিল। খবর বিবিসি বাংলার।

কিন্তু জর্ডানের মাফরাক বিমানঘাঁটি ধ্বংস করার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ার আগেই ইসরাইলি বিমানবাহিনী নিজেদের দুটি যুদ্ধবিমান হারায়। এর মধ্যে একটি বিমানকে ভূপাতিত করেছিলেন যে পাইলট, তিনি এক বাঙালি। নাম তার সাইফুল আজম।

তিনি পাকিস্তান বিমানবাহিনীর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ছিলেন, পরে বাংলাদেশের বিমানবাহিনীতে যোগ দেন। সাইফুল আজম বাংলাদেশসহ একাধিক দেশের বিমানবাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন।

৫ জুন জর্ডান বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান ওড়ানোর সময় তিনি ইসরাইলি যুদ্ধবিমানকে গুলি করে ভূপাতিত করেন। এর ঠিক দুদিন পর ৭ জুন ইরাকের বিমানবাহিনীর একটা বিমান ওড়ানোর সময় আরও দুটি ইসরাইলি যুদ্ধবিমানকেও ভূপাতিত করেন তিনি।

১৯৬০ সালে পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে কমিশন পাওয়া সাইফুল আজম ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ভারতীয় বিমানবাহিনীরও একটি বিমান গুলি করে ভূপাতিত করেছিলেন।

‘দ্য গোল্ড বার্ড: পাকিস্তান অ্যান্ড ইটস এয়ারফোর্স, অবজারভেশনস অফ আ পাইলট’ বইয়ে মনসুর শাহ লিখেছেন— আমাদের (পাকিস্তানের) বিমানবাহিনীর টেকনিশিয়ানদের ৩৫ শতাংশ এবং সাইফুল আজমের মতো চমৎকার পাইলটসহ বিমানচালকদের এক-চতুর্থাংশ ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের।

পাকিস্তানের ফ্লাইট লেফটেন্যান্টের পদে থাকাকালীন ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় ভারতীয় যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করার পর তাকে পাকিস্তান সরকার সামরিক পদক ‘সিতারা-ই-জুরাত’ দিয়ে সম্মানিত করে।

এরপর ১৯৬৬ সালের শেষের দিকে তিনি জর্ডান বিমানবাহিনীর উপদেষ্টা হিসাবে নিযুক্ত হন। পরের বছর আরও একটি যুদ্ধে লড়েন তিনি। ওই যুদ্ধে একদিকে ছিল ইসরাইল, অন্যদিকে জর্ডান, মিশর, সিরিয়া ও ইরাকসহ আরব দেশগুলোর জোট।

ইসরাইল হঠাৎ মিশরীয় বিমানবাহিনীর ওপর হামলা চালানোর সূত্র ধরে যুদ্ধের শুরু হয়। মিশর হঠাৎ বড়-সড় ধাক্কা খাওয়ার পর জর্ডানের বিমানবাহিনীকেও সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল।

ইতিহাসবিদ ও সাবেক এয়ার কমোডর কায়সার তুফায়েল তার গ্রেট এয়ার ব্যাটলস অফ পাকিস্তান এয়ার ফোর্স’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে আকাশ প্রতিরক্ষার সীমিত অনুমতি পাওয়ার পর সাইফুল আজম জর্ডানের মাফরাক বিমানঘাঁটি থেকে লেফটেন্যান্ট এহসান শারদুমকে নিয়ে হান্টার বিমানে সওয়ার হয়ে উড়ান শুরু করেন। তাদের পেছনে পেছনে অন্যান্য হান্টার বিমানও উড়তে শুরু করে।

কায়সার তুফায়েল লিখেছেন, মরুভূমির ধুলাবালি ও উত্তাপের কারণে, দৃষ্টিশক্তি এক মাইলেরও কম ছিল। শত্রুর কোনো চিহ্নই দেখা যাচ্ছিল না। সাইফুল রাডারে মাফরাক বিমানঘাঁটির দিকে ইসরাইলি বিমান আসছে কিনা জানতে চাইলে, জবাব আসে ‘হ্যাঁ’। সঙ্গে সঙ্গে মাফরাকের উদ্দেশ্যে রওনা দেন সাইফুল।

জর্ডানের আশঙ্কা ছিল, মিশরের পর ইসরাইলি বিমানবাহিনী সেখানে হামলা চালাবে।

কায়সার তুফায়েল লিখেছেন, তিনি মাফরাক বিমানঘাঁটি থেকে চার মাইল দূরে চারটি বিমানকে কম উচ্চতায় যুদ্ধবিন্যাসে উড়তে দেখেন। অনুমান করেন যে এটা ইসরাইলি মিস্টেয়ার বিমান।

কায়সার তুফায়েল লিখেছেন, ‘ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সাইফুল আজম দেখলেন দুটো মিস্টেয়ার বিমান পূর্ণ গতিতে পশ্চিম দিকে যাচ্ছে। সাইফুল তাকে ধাওয়া করতে করতেই এহসান তার ডান দিকে আরেকটি শত্রু বিমানকে লক্ষ্য করেন। তিনি এহসানকে একটা শত্রু বিমানকে ধাওয়া করার নির্দেশ দেন আর নিজে অন্য দুটো শত্রু বিমানের পেছনে ধাওয়া করেন।’

‘সাইফুল একটা মিস্টেয়ারের পেছনে চলে আসেন, যে বিমানটি দ্রুত সমারসল্ট করে পালানোর চেষ্টা করছিল। সাইফুল ওই বিমানকে লক্ষ্য করে চারবার গুলি ছুড়লেও তার কোনোটাই লক্ষ্যে লাগেনি।’

কায়সার তুফায়েল লিখেছেন, ‘তিনি কিছুটা হতাশ হয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু হঠাৎই লক্ষ্য করেন যে শত্রু বিমান সোজা উড়তে শুরু করেছে। ব্যবধান কমিয়ে পঞ্চমবার নিশানা করেন সাইফুল। এবার মিস্টেয়ারের ডান দিক থেকে ধোঁয়া বেরোতে শুরু করে। অর্থাৎ গুলি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত লেগেছে।’

‘ওই বিমানটা কাত হয়ে যায়, কিন্তু পুরো ধ্বংস হয়েছে কিনা তা দেখতে পাননি সাইফুল। কারণ ততক্ষণে অন্য একটি ইসরাইলি বিমান তাকে আক্রমণ করার জন্য ঘুরছিল।’

কায়সার তুফায়েল আরও লিখেছেন, ‘জ্বালানি ও গোলাবারুদের অভাবে সাইফুল পিছু হটার সিদ্ধান্ত নেন এবং মাফরাকে ফিরে আসেন। তার আশঙ্কা ছিল, মাফরাকের রানওয়ে হয়তো কাজ করার মতো অবস্থাতে নেই। তাই তিনি সব বিমানকে এয়ারফিল্ডের উত্তরে অপেক্ষা করার নির্দেশ দেন। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তাদের রানওয়েতে অবতরণের অনুমতি দেওয়া হয়।’

‘কিন্তু এহসান বিপদ বুঝতে পেরে রেডিওতে নিয়ন্ত্রকের পরিচয় এবং তার কুকুরের নামও জানতে চান, যা আসলে একটা গোয়েন্দা কোড ছিল। সেই একই সময়ে জর্ডানের নিয়ন্ত্রক রেডিওতে এসে মাফরাকে অবতরণ না করার জন্য সতর্ক করেন।’

এহসান শারদুমের উপস্থিত বুদ্ধি তাদের দুজনকেই এই বিপজ্জনক ইসরাইলি ফাঁদ থেকে রক্ষা করেছিল। প্রকৃতপক্ষে ওই রানওয়ে ততক্ষণে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল এবং অবতরণ করার জন্য অনুমতির রেডিও বার্তা আসলে একটি ফাঁদ ছিল।

‘সব বিমানকে রাজধানী আম্মানের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়, যেখানে তখনো ইসরাইলিরা হামলা চালায়নি। ভাগ্যবশত পাইলটরা হামলার কিছুক্ষণ আগে অবতরণ করে।’

‘কিন্তু তাদের বিমানগুলো রক্ষা পায়নি। অবতরণের কিছুক্ষণ পরেই আধুনিক সুপার-মিস্টিক প্লেনগুলো ডাইবার বোমা ব্যবহার করে আক্রমণ চালায়, যার ফলে রানওয়ের ব্যাপক ক্ষতি হয়।’

কায়সার তুফায়েল লিখেছেন, ৭ জুন সকালে খুবই নিচু গলায় কারও কোথায় ঘুম ভাঙে সাইফুলের। বেস কমান্ডারের বার্তা নিয়ে তার কাছে পৌঁছান ইরাকের এক তরুণ অফিসার। ওই বার্তায় জানানো হয়েছিল তিনি (বেস কমান্ডার) প্রথম ফ্লাইটের জন্য চার পাইলটকে এগিয়ে আসতে বলেছেন এবং আপনাকে নেতৃত্ব দিতে বলা হয়েছে!

এরপর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে চলে যান তিনি এবং সেখানে বিমানবাহিনীতে যোগ দেন। ২০০১ সালে ‘লিভিং ঈগল’ হিসেবে তার নাম ইন্টারন্যাশনাল হল অফ ফেম-এর অন্তর্ভুক্ত হয়।

পাকিস্তান বিমানবাহিনী ম্যাগাজিনের ‘সেকেন্ড টু নান’-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে এয়ার কমোডর মোহাম্মদ আলী লিখেছেন, সাইফুল আজম চার দেশের (পাকিস্তান, জর্ডান, ইরাক ও বাংলাদেশ) বিমানবাহিনীতে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং দুই দেশের (ভারত ও ইসরাইল) বিমান গুলি করে ভূপাতিত করেছেন।

অবসরের পর বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে পাবনা থেকে অংশ নিয়ে তিনি সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন।

বাংলাদেশের সামরিক কর্মকর্তা ও বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার শহীদুল ইনাম খান তার লেখায় উল্লেখ করেছেন, সাইফুল আজমের সাহসিকতা ইসরাইলেও প্রশংসিত হয়। ২০২০ সালের জুন মাসে তার মৃত্যুর পর প্রধান সংবাদপত্রগুলো সাইফুল আজমের বিষয়ে বিশেষ নিবন্ধ প্রকাশ করেছিল।

শহীদুল ইনাম খান লিখেছিলেন, ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে যখন একটি ইসরাইলি বিমানকে নিশানা করেছিলেন সাইফুল, তখন সরাসরি আক্রমণ করার বদলে পাশ থেকে নিশানা করেন এবং বিমানের লেজে গুলি করেন। ইসরাইলি পাইলট প্রাণে বেঁচে যান। প্যারাসুটের সাহায্যে অবতরণ করেন তিনি।

ইনাম খান লিখেছেন, পাইলট পরে জানান তিনি যখন নিচে নামছিলেন, তখন সাইফুল রোল অ্যান্ড লুপ দিয়ে তার দিকে হাত নাড়েন এবং এরপর তিনি আরেকটি ইসরাইলি বিমানকে গুলি করে ভূপাতিত করার জন্য ধেয়ে যান। সাইফুল না চাইলে ওই পাইলট বাঁচতেন না।

জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ছয় দিনের যুদ্ধ শেষ হয়, কিন্তু ততদিনে ইসরাইল গোলান মালভূমি, গাজা, সিনাই উপদ্বীপ ও পশ্চিমতীর (পূর্ব জেরুজালেমসহ) দখল করে নেয় এবং মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র পুরোপুরি বদলে দেয়। তবে এই লড়াই সাইফুল আজমের কীর্তির জন্য আজও স্মরণীয় হয়ে আছে।

নিউজটি শেয়ার করুন