০২:৫৩ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ০৬ জুন ২০২৫

ঈদুল আযহা মুসলমানদের গুরুত্ব পূর্ণদিন

মিসবাহ উদ্দিন :
  • আপডেট সময়ঃ ১২:৪০:৩৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৪ জুন ২০২৫
  • / ১৩ বার পড়া হয়েছে।

কোরবানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। সামর্থ্যবান নর-নারীর ওপর কোরবানি ওয়াজিব। আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের শর্তহীন আনুগত্যের শিক্ষা রয়েছে কোরবানিতে। পাশাপাশি আল্লাহ তাআলার জন্য ত্যাগ ও বিসর্জনের শিক্ষাও আছে এতে।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘আপনি আপনার রবের উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি আদায় করুন।’ (সুরা : কাউসার, আয়াত : ২)
অন্য আয়াতে এসেছে, ‘হে রাসুল! আপনি বলুন, আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন, আমার মরণ আল্লাহ রাববুল আলামিনের জন্য উৎসর্গিত।’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ১৬২)

ঈদুল আজহা (আরবীতে:عيد الأضحى) ইসলাম ধর্মাবলম্বিদের সবচেয়ে বড় দু’টো ধর্মীয় উৎসবের একটি। বাংলাদেশে এই উৎসবটি কুরবানির ঈদ নামে পরিচিত। ঈদুল আযহা মূলত আরবী বাক্যাংশ।
কোরবানি শব্দের অর্থ নৈকট্য, ত্যাগ, উৎসর্গ। অর্থাৎ আল্লাহতায়ালার নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যেই এ কোরবানি। কোরবানির ঈদপালনের মাধ্যমে বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা আল্লাহর প্রিয় বান্দা ও নবী হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও হজরত ইসমাইল (আ.)-এর অতুলনীয় আনুগত্য এবং মহান ত্যাগের পুণ্যময় স্মৃতি বহন করে। আল্লাহপাকের সন্তুষ্টির জন্য মুসলিম উম্মাহ প্রতি বছর পশু কোরবানি করে থাকে। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে নির্দেশ দিচ্ছেন, ‘অতএব আপনি আপনার পালনকর্তার উদ্দেশ্যে নামাজ পড়–ন এবং কোরবানি করুন।’ (সুরা কাউসার, আয়াত : ২)। কোরবানি একটি প্রতীকী ব্যাপার। এখানে পশু কোরবানির মাধ্যমে মুসলমানরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জানমাল থেকে শুরু করে সবকিছুই কোরবানি করতে প্রস্তুত। হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও তার পুরো পরিবারের নজিরবিহীন কোরবানির ইতিহাস মানুষকে যে ত্যাগের শিক্ষা দেয়, তাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে একজন মুমিন তার সবকিছুই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করতে সদা প্রস্তুত থাকে।

হজরত ইব্রাহিম (আ.) এবং প্রিয় পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.) এবং মা হাজেরার আল্লাহর প্রতি গভীর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশগুলো আল্লাহতায়ালা হজের অংশ হিসেবে গণ্য করেছেন। আল্লাহতায়ালা হজরত ইব্রাহিম (আ.)-কে স্বপ্নে দেখালেন, তিনি তার ছেলেকে জবেহ করছেন। (সুরা সাফ)। যেভাবে কোরবানি কবিতায় কবি নজরুল বলেছেন : এই দিনই মিনা ময়দানে, পুত্র-স্নেহের গর্দানে, ছুরি হেনে খুন ক্ষরিয়ে নে, রেখেছে আব্বা ইব্রাহিম সে আপনা রুদ্র পণ! ছি ছি! কেঁপো না ক্ষুদ্র মন! আজ জল্লাদ নয়, প্রহ্লাদ-সম মোল্লা খুন-বদন! ওরে হত্যা নয় আজ সত্যগ্রহ শক্তির উদ্বোধন।’ পিতা ইব্রাহিম স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে গেলে আল্লাহ বললেন, আরে ইব্রাহিম, তুমি তোমার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছ। আমি তোমাকে নিজ পুত্রকে আমার পথে উৎসর্গ করতে বলেছি, হত্যা করতে নয়। তোমার পুত্র সারাজীবন লোকদের বোঝাবে আল্লাহ এক-অদ্বিতীয়। প্রশ্ন হলো, তাহলে কেন দুম্বা বা ছাগল জবাই করলেন? এর উত্তর হলো : যদি সেদিন এই ঘটনা না ঘটত তাহলে তৎকালীন ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী কোনো কোনো জাতিতে প্রভুকে বা দেব-দেবীদের খুশি করার জন্য নরবলি তথা মানুষ কোরবানি চলমান থাকত। অতএব আল্লাহ মানবজাতিকে শিক্ষা দিলেন, মানুষ জবেহ করার জিনিস নয়, জবেহ যদি করতে হয়, তাহলে পশু জবেহ করো।

ইতিহাস পাঠে জানা যায়,
ইসলামের বিভিন্ন বর্ননা অণুযায়ী, মহান আল্লাহতাআলা ইসলামের নবী হযরত ইব্রাহীম(আঃ)কে স্বপ্নে তার সবচেয়ে প্রিয় বস্তুটি কুরবানী করার নির্দেশ দেন। এই আদেশ অণুযায়ী হযরত ইব্রাহিম(আঃ)তার সবচেয়ে প্রিয় পুত্র ইসমাইলকে কুরবানি করার জন্য প্রস্তুত হলে স্রষ্টা তাকে তা করতে বাধা দেন এবং পুত্রের পরিবর্তে পশু কুরবানীর নির্দেশ দেন। এই ঘটনাকে স্মরণ করে সারা বিশ্বের মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্ঠি অর্জনের জন প্রতি বছর এই দিবসটি পালন করে। হজরত রাসুলে পাক (সা.)-এর শ্রদ্ধেয় পিতা একবার অসুস্থ হলে তার দাদা এক শ উট জবেহ করেছিলেন (সিরাতে নববী)। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, পশু জবাই করা রাসুল (সা.) প্রচলন করেননি বরং আগেই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পশু জবাই করা হতো। পশু কোরবানির আরো একটি উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। কোরআনে মুসা (আ.)-এর জাতিকে আল্লাহ শিক্ষা দিয়েছেন, ‘তোমরা যে গাভীকে পূজা করো, সে পূজনীয় নয় বরং আমি পূজনীয়, অতএব সেটাকে জবেহ করো।’ (সুরা আল-বাকারা, রুকু : ৮)। গরু তোমাদের উপকারার্থে সৃষ্টি করা হয়েছে। যেন তোমরা এর দুধ পান করতে পারো এবং গোশত খেতে পারো আর এর মাধ্যমে অন্যান্য উপকার সাধন করতে পারো। মূল উদ্দেশ্য হলো, হৃদয়েও যদি কোনো পশু থাকে সেই পশুকে হত্যা করতে হবে। সেটাকে জবাই করতে হবে। হাদিসে আছে, পশু জবাই খোদাতালার নৈকট্য লাভের একটি মাধ্যম তবে তা ওই ব্যক্তির জন্য যে নিষ্ঠার সঙ্গে কেবল খোদাতালার ভালোবাসায়, খোদার ইবাদাতের উদ্দেশ্যে ইমান সহকারে পশু জবাই করে এমন কোরবানিকে আরবিতে ‘নুসক’ বলা হয়েছে, যার আরেকটি অর্থ অনুগত্য।

আসলে আল্লাহ মানুষের অন্তর দেখেন, কে কোন উদ্দেশ্যে কোরবানি করছে, তা তিনি ভালো করেই জানেন। আসলে মানুষের মধ্যে সব লোভ-লালসা দূর করে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে সব পশুত্বকে বিসর্জনের শিক্ষাই হলো কোরবানির শিক্ষা। তাই কোরবানির অন্যতম ধর্মীয় উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষের মধ্যে পশুত্বকে হত্যা করে মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে তোলা। কাজী নজরুল ইসলাম তার এক কবিতায় বিষয়টি এভাবে তুলে ধরেছেনÑ‘মনের পশুরে করো জবাই/পশুরাও বাঁচে বাঁচে সবাই।’ এই পশু কোরবানি সম্পূর্ণ রূপক। আল্লাহর পথে ত্যাগই ঈদের আসল শিক্ষা। আল্লাহর নামে পশু কোরবানি করে তা মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়ার মানে দান নয়, তা ত্যাগ। তাই তো কবি নজরুল ‘ঈদজ্জোহা’ কবিতায় লিখেছেন, ‘চাহি নাকো দুম্বা-উট, কতটুকু দান? ও দান ঝুট। চাই কোরবানি, চাই না দান।’

আত্মত্যাগের মহিমায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যারা আল্লাহর নামে কোরবানি করে তাদের জন্য সীমাহীন সওয়াবের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন রাসুলুল্লাহ (সা.)। মহানবী (সা.) বিভিন্ন সময় কোরবানির বিষয়ে তার উম্মতকে নসিহত করেছেন। কারো হৃদয়ে যদি এমন ধারণার উদ্রেক হয়, প্রতি বছরই তো কোরবানি দিয়ে যাচ্ছি, এবার না হয় দিলাম না, এমনটি চিন্তাভাবনা মোটেও ঠিক নয়, কেননা কোরবানি শুধু একবারের জন্য নয় বরং তা সারা জীবনের জন্য। হাদিস থেকে জানা যায়, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘হে লোক সকল! জেনে রাখ, প্রত্যেক পরিবারের পক্ষে প্রত্যেক বছরই কোরবানি করা আবশ্যক।’ (আবু দাউদ ও নাসাঈ)। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য লাভ করে অথচ কোরবানির আয়োজন করেনি, সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছে না আসে।’ (ইবনে মাজাহ)। হজরত ইবনে উমর (রা.) বলেন, রাসুল করিম (সা.) মদিনায় ১০ বছর অবস্থান করেছেন এবং বরাবর কোরবানি করেছেন (তিরমিজি)। মহানবী (সা.) বলেছেন, কোরবানির দিনে কোরবানি করাই সবচেয়ে বড় ইবাদত। কোরবানির জন্তুর শরীরের প্রতিটি পশমের বিনিময়ে কোরবানিদাতাকে একটি করে সওয়াব দান করা হবে। কোরবানির পশুর রক্ত জবাই করার সময় মাটিতে পড়ার আগেই তা আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যায়। (মেশকাত)। কোরবানির বিনিময়ে সওয়াব পেতে হলে অবশ্যই কোরবানিটা হতে হবে একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে। যেভাবে পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেছেন, ‘কোরবানির জন্তুর রক্ত-মাংস কোনো কিছুই আল্লাহর দরবারে পৌঁছায় না। তার কাছে পৌঁছায় শুধু তোমাদের অন্তরের তাকওয়া।’ (সুরা আল-হাজ : ৩৭)। অতএব তাকওয়া তথা খোদাভীতি লাভের উদ্দেশ্যেই এ কোরবানি। আর প্রকৃত কোরবানি হলো নিজ আত্মার কলুষতাকে জবাহ করা, আত্মার আমিত্বকে জবেহ করা, আত্মার অহংকারকে জবেহ করা।

এখন আমাদের ভাবতে হবে, আমাদের এ কোরবানি কি তাকওয়ার কোরবানি নাকি লোক দেখানো কোরবানি? ঈদুল আজহা আসার আগ মুহূর্তে ফ্রিজ কোম্পানিগুলোর চটকদার বিজ্ঞাপন, ডিপ ফ্রিজে বিরাট ছাড়Ñএগুলো কি আমাদের তাকওয়ার দিকে আকর্ষণ করছে, নাকি গোশত জমানোর দিকে? আল্লাহর রাসুল কোরবানির গোশত কোন ফ্রিজে রাখতেন? নিজেরা সামান্য খেয়ে বাকিটা সবার মধ্যে বণ্টন করে দিতেন। কেউ হয়তো বলতে পারেন তখন তো ফ্রিজ ছিল না, কিন্তু গোশত অতিরিক্ত হলে শুকনো করে রাখতে পারত কিন্তু তিনি (সা.) কখনো তা করেননি। আমাদের এত বড় ছাড় দেওয়া হয়েছে, তিনভাগের একভাগ নিজেরা খাব, একভাগ আত্মীয়দের দেব আর একভাগ গরিব মিসকিনদের। বাস্তবে দেখা যায়, পারলে সবটা নিয়ে ফ্রিজে ঢোকানো হয়। আর তা-ও যদি না হয়, তবে তিনভাগের একভাগ বিলিয়ে দিয়ে বাকি দুভাগ ফ্রিজে। আত্মীয়ের ভাগের কথা বললে বলে, আত্মীয় তো বাসায় এসে রান্না করা গোশত খাবে! কত বড় স্বার্থপর আমরা। সবাই যদি আত্মীয়ের ভাগ আত্মীয়কে দিই, তাহল প্রত্যেকের সঙ্গে একটা হৃদ্যতার সম্পর্ক সৃষ্টি হবে আর আল্লাহপাকও খুশি হবেন। তাহলে এ বিষয়ে আমাদের কেন এত কার্পণ্য।

মহান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা এটাই, হে আল্লাহ! আমাদের এ কোরবানি তুমি গ্রহণ করো আর আমাদের আত্মাকে পবিত্র করো।
ঈদুল আজহা সবার জীবনে বয়ে আনুক অনাবিল সুঃখ শান্তিতে ভরেঊঠুক সবার জীবন এই প্রত্যাশায়।

নিউজটি শেয়ার করুন
ট্যাগসঃ

বিস্তারিত লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষণ করুন

আপলোডকারীর তথ্য

ঈদুল আযহা মুসলমানদের গুরুত্ব পূর্ণদিন

আপডেট সময়ঃ ১২:৪০:৩৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৪ জুন ২০২৫

কোরবানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। সামর্থ্যবান নর-নারীর ওপর কোরবানি ওয়াজিব। আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের শর্তহীন আনুগত্যের শিক্ষা রয়েছে কোরবানিতে। পাশাপাশি আল্লাহ তাআলার জন্য ত্যাগ ও বিসর্জনের শিক্ষাও আছে এতে।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘আপনি আপনার রবের উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি আদায় করুন।’ (সুরা : কাউসার, আয়াত : ২)
অন্য আয়াতে এসেছে, ‘হে রাসুল! আপনি বলুন, আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন, আমার মরণ আল্লাহ রাববুল আলামিনের জন্য উৎসর্গিত।’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ১৬২)

ঈদুল আজহা (আরবীতে:عيد الأضحى) ইসলাম ধর্মাবলম্বিদের সবচেয়ে বড় দু’টো ধর্মীয় উৎসবের একটি। বাংলাদেশে এই উৎসবটি কুরবানির ঈদ নামে পরিচিত। ঈদুল আযহা মূলত আরবী বাক্যাংশ।
কোরবানি শব্দের অর্থ নৈকট্য, ত্যাগ, উৎসর্গ। অর্থাৎ আল্লাহতায়ালার নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যেই এ কোরবানি। কোরবানির ঈদপালনের মাধ্যমে বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা আল্লাহর প্রিয় বান্দা ও নবী হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও হজরত ইসমাইল (আ.)-এর অতুলনীয় আনুগত্য এবং মহান ত্যাগের পুণ্যময় স্মৃতি বহন করে। আল্লাহপাকের সন্তুষ্টির জন্য মুসলিম উম্মাহ প্রতি বছর পশু কোরবানি করে থাকে। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে নির্দেশ দিচ্ছেন, ‘অতএব আপনি আপনার পালনকর্তার উদ্দেশ্যে নামাজ পড়–ন এবং কোরবানি করুন।’ (সুরা কাউসার, আয়াত : ২)। কোরবানি একটি প্রতীকী ব্যাপার। এখানে পশু কোরবানির মাধ্যমে মুসলমানরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জানমাল থেকে শুরু করে সবকিছুই কোরবানি করতে প্রস্তুত। হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও তার পুরো পরিবারের নজিরবিহীন কোরবানির ইতিহাস মানুষকে যে ত্যাগের শিক্ষা দেয়, তাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে একজন মুমিন তার সবকিছুই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করতে সদা প্রস্তুত থাকে।

হজরত ইব্রাহিম (আ.) এবং প্রিয় পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.) এবং মা হাজেরার আল্লাহর প্রতি গভীর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশগুলো আল্লাহতায়ালা হজের অংশ হিসেবে গণ্য করেছেন। আল্লাহতায়ালা হজরত ইব্রাহিম (আ.)-কে স্বপ্নে দেখালেন, তিনি তার ছেলেকে জবেহ করছেন। (সুরা সাফ)। যেভাবে কোরবানি কবিতায় কবি নজরুল বলেছেন : এই দিনই মিনা ময়দানে, পুত্র-স্নেহের গর্দানে, ছুরি হেনে খুন ক্ষরিয়ে নে, রেখেছে আব্বা ইব্রাহিম সে আপনা রুদ্র পণ! ছি ছি! কেঁপো না ক্ষুদ্র মন! আজ জল্লাদ নয়, প্রহ্লাদ-সম মোল্লা খুন-বদন! ওরে হত্যা নয় আজ সত্যগ্রহ শক্তির উদ্বোধন।’ পিতা ইব্রাহিম স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে গেলে আল্লাহ বললেন, আরে ইব্রাহিম, তুমি তোমার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছ। আমি তোমাকে নিজ পুত্রকে আমার পথে উৎসর্গ করতে বলেছি, হত্যা করতে নয়। তোমার পুত্র সারাজীবন লোকদের বোঝাবে আল্লাহ এক-অদ্বিতীয়। প্রশ্ন হলো, তাহলে কেন দুম্বা বা ছাগল জবাই করলেন? এর উত্তর হলো : যদি সেদিন এই ঘটনা না ঘটত তাহলে তৎকালীন ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী কোনো কোনো জাতিতে প্রভুকে বা দেব-দেবীদের খুশি করার জন্য নরবলি তথা মানুষ কোরবানি চলমান থাকত। অতএব আল্লাহ মানবজাতিকে শিক্ষা দিলেন, মানুষ জবেহ করার জিনিস নয়, জবেহ যদি করতে হয়, তাহলে পশু জবেহ করো।

ইতিহাস পাঠে জানা যায়,
ইসলামের বিভিন্ন বর্ননা অণুযায়ী, মহান আল্লাহতাআলা ইসলামের নবী হযরত ইব্রাহীম(আঃ)কে স্বপ্নে তার সবচেয়ে প্রিয় বস্তুটি কুরবানী করার নির্দেশ দেন। এই আদেশ অণুযায়ী হযরত ইব্রাহিম(আঃ)তার সবচেয়ে প্রিয় পুত্র ইসমাইলকে কুরবানি করার জন্য প্রস্তুত হলে স্রষ্টা তাকে তা করতে বাধা দেন এবং পুত্রের পরিবর্তে পশু কুরবানীর নির্দেশ দেন। এই ঘটনাকে স্মরণ করে সারা বিশ্বের মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্ঠি অর্জনের জন প্রতি বছর এই দিবসটি পালন করে। হজরত রাসুলে পাক (সা.)-এর শ্রদ্ধেয় পিতা একবার অসুস্থ হলে তার দাদা এক শ উট জবেহ করেছিলেন (সিরাতে নববী)। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, পশু জবাই করা রাসুল (সা.) প্রচলন করেননি বরং আগেই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পশু জবাই করা হতো। পশু কোরবানির আরো একটি উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। কোরআনে মুসা (আ.)-এর জাতিকে আল্লাহ শিক্ষা দিয়েছেন, ‘তোমরা যে গাভীকে পূজা করো, সে পূজনীয় নয় বরং আমি পূজনীয়, অতএব সেটাকে জবেহ করো।’ (সুরা আল-বাকারা, রুকু : ৮)। গরু তোমাদের উপকারার্থে সৃষ্টি করা হয়েছে। যেন তোমরা এর দুধ পান করতে পারো এবং গোশত খেতে পারো আর এর মাধ্যমে অন্যান্য উপকার সাধন করতে পারো। মূল উদ্দেশ্য হলো, হৃদয়েও যদি কোনো পশু থাকে সেই পশুকে হত্যা করতে হবে। সেটাকে জবাই করতে হবে। হাদিসে আছে, পশু জবাই খোদাতালার নৈকট্য লাভের একটি মাধ্যম তবে তা ওই ব্যক্তির জন্য যে নিষ্ঠার সঙ্গে কেবল খোদাতালার ভালোবাসায়, খোদার ইবাদাতের উদ্দেশ্যে ইমান সহকারে পশু জবাই করে এমন কোরবানিকে আরবিতে ‘নুসক’ বলা হয়েছে, যার আরেকটি অর্থ অনুগত্য।

আসলে আল্লাহ মানুষের অন্তর দেখেন, কে কোন উদ্দেশ্যে কোরবানি করছে, তা তিনি ভালো করেই জানেন। আসলে মানুষের মধ্যে সব লোভ-লালসা দূর করে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে সব পশুত্বকে বিসর্জনের শিক্ষাই হলো কোরবানির শিক্ষা। তাই কোরবানির অন্যতম ধর্মীয় উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষের মধ্যে পশুত্বকে হত্যা করে মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে তোলা। কাজী নজরুল ইসলাম তার এক কবিতায় বিষয়টি এভাবে তুলে ধরেছেনÑ‘মনের পশুরে করো জবাই/পশুরাও বাঁচে বাঁচে সবাই।’ এই পশু কোরবানি সম্পূর্ণ রূপক। আল্লাহর পথে ত্যাগই ঈদের আসল শিক্ষা। আল্লাহর নামে পশু কোরবানি করে তা মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়ার মানে দান নয়, তা ত্যাগ। তাই তো কবি নজরুল ‘ঈদজ্জোহা’ কবিতায় লিখেছেন, ‘চাহি নাকো দুম্বা-উট, কতটুকু দান? ও দান ঝুট। চাই কোরবানি, চাই না দান।’

আত্মত্যাগের মহিমায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যারা আল্লাহর নামে কোরবানি করে তাদের জন্য সীমাহীন সওয়াবের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন রাসুলুল্লাহ (সা.)। মহানবী (সা.) বিভিন্ন সময় কোরবানির বিষয়ে তার উম্মতকে নসিহত করেছেন। কারো হৃদয়ে যদি এমন ধারণার উদ্রেক হয়, প্রতি বছরই তো কোরবানি দিয়ে যাচ্ছি, এবার না হয় দিলাম না, এমনটি চিন্তাভাবনা মোটেও ঠিক নয়, কেননা কোরবানি শুধু একবারের জন্য নয় বরং তা সারা জীবনের জন্য। হাদিস থেকে জানা যায়, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘হে লোক সকল! জেনে রাখ, প্রত্যেক পরিবারের পক্ষে প্রত্যেক বছরই কোরবানি করা আবশ্যক।’ (আবু দাউদ ও নাসাঈ)। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য লাভ করে অথচ কোরবানির আয়োজন করেনি, সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছে না আসে।’ (ইবনে মাজাহ)। হজরত ইবনে উমর (রা.) বলেন, রাসুল করিম (সা.) মদিনায় ১০ বছর অবস্থান করেছেন এবং বরাবর কোরবানি করেছেন (তিরমিজি)। মহানবী (সা.) বলেছেন, কোরবানির দিনে কোরবানি করাই সবচেয়ে বড় ইবাদত। কোরবানির জন্তুর শরীরের প্রতিটি পশমের বিনিময়ে কোরবানিদাতাকে একটি করে সওয়াব দান করা হবে। কোরবানির পশুর রক্ত জবাই করার সময় মাটিতে পড়ার আগেই তা আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যায়। (মেশকাত)। কোরবানির বিনিময়ে সওয়াব পেতে হলে অবশ্যই কোরবানিটা হতে হবে একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে। যেভাবে পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেছেন, ‘কোরবানির জন্তুর রক্ত-মাংস কোনো কিছুই আল্লাহর দরবারে পৌঁছায় না। তার কাছে পৌঁছায় শুধু তোমাদের অন্তরের তাকওয়া।’ (সুরা আল-হাজ : ৩৭)। অতএব তাকওয়া তথা খোদাভীতি লাভের উদ্দেশ্যেই এ কোরবানি। আর প্রকৃত কোরবানি হলো নিজ আত্মার কলুষতাকে জবাহ করা, আত্মার আমিত্বকে জবেহ করা, আত্মার অহংকারকে জবেহ করা।

এখন আমাদের ভাবতে হবে, আমাদের এ কোরবানি কি তাকওয়ার কোরবানি নাকি লোক দেখানো কোরবানি? ঈদুল আজহা আসার আগ মুহূর্তে ফ্রিজ কোম্পানিগুলোর চটকদার বিজ্ঞাপন, ডিপ ফ্রিজে বিরাট ছাড়Ñএগুলো কি আমাদের তাকওয়ার দিকে আকর্ষণ করছে, নাকি গোশত জমানোর দিকে? আল্লাহর রাসুল কোরবানির গোশত কোন ফ্রিজে রাখতেন? নিজেরা সামান্য খেয়ে বাকিটা সবার মধ্যে বণ্টন করে দিতেন। কেউ হয়তো বলতে পারেন তখন তো ফ্রিজ ছিল না, কিন্তু গোশত অতিরিক্ত হলে শুকনো করে রাখতে পারত কিন্তু তিনি (সা.) কখনো তা করেননি। আমাদের এত বড় ছাড় দেওয়া হয়েছে, তিনভাগের একভাগ নিজেরা খাব, একভাগ আত্মীয়দের দেব আর একভাগ গরিব মিসকিনদের। বাস্তবে দেখা যায়, পারলে সবটা নিয়ে ফ্রিজে ঢোকানো হয়। আর তা-ও যদি না হয়, তবে তিনভাগের একভাগ বিলিয়ে দিয়ে বাকি দুভাগ ফ্রিজে। আত্মীয়ের ভাগের কথা বললে বলে, আত্মীয় তো বাসায় এসে রান্না করা গোশত খাবে! কত বড় স্বার্থপর আমরা। সবাই যদি আত্মীয়ের ভাগ আত্মীয়কে দিই, তাহল প্রত্যেকের সঙ্গে একটা হৃদ্যতার সম্পর্ক সৃষ্টি হবে আর আল্লাহপাকও খুশি হবেন। তাহলে এ বিষয়ে আমাদের কেন এত কার্পণ্য।

মহান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা এটাই, হে আল্লাহ! আমাদের এ কোরবানি তুমি গ্রহণ করো আর আমাদের আত্মাকে পবিত্র করো।
ঈদুল আজহা সবার জীবনে বয়ে আনুক অনাবিল সুঃখ শান্তিতে ভরেঊঠুক সবার জীবন এই প্রত্যাশায়।

নিউজটি শেয়ার করুন