কর্মস্থলে শ্রমিকের মৃত্যু কমছে না ।

- আপডেট সময়ঃ ১২:৩২:৪৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ২ অগাস্ট ২০২৫
- / ১৮ বার পড়া হয়েছে।

চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশের বিভিন্ন খাতে কর্মরত অন্তত ৪২২ জন শ্রমিক কর্মস্থল-সংশ্লিষ্ট দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন। বিষয়টি শ্রমিক নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি করছে, কারণ গত বছরের একই সময়ে এ সংখ্যা ছিল ৪৭৫ জন। যদিও সংখ্যায় খানিকটা কমতির দিকে, দুর্ঘটনার ধরন এবং পুনরাবৃত্তির প্রবণতা বিশেষজ্ঞদের মতে কাঠামোগত দুর্বলতা ও সমন্বয়হীনতার দিকেই ইঙ্গিত করছে। বেসরকারি পর্যবেক্ষণ সংস্থা সেইফটি অ্যান্ড রাইটস সোসাইটি (এসআরএস)-এর সামপ্রতিক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে মোট ৩৭৩টি কর্মস্থল-সংশ্লিষ্ট দুর্ঘটনায় শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। আগের বছরের একই সময়ে এই সংখ্যাটি ছিল ৪২০টি। এসআরএসের তথ্য অনুযায়ী, পরিবহন খাতে সবচেয়ে বেশি ২০৭ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। সেবামূলক খাতে প্রাণ গেছে ৬৫ জনের, কৃষি ও নির্মাণ খাতে ৫৯ জন করে এবং কল-কারখানা ও উৎপাদন খাতে প্রাণ হারিয়েছেন ৩২ জন শ্রমিক। মৃত্যুর কারণ বিশ্লেষণে দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ২৬৭ জন, বজ্রপাতে ৫৬ জন, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ৪০ জন, ভবনের ওপর থেকে পড়ে ২৩ জন, ভারী বস্তুর আঘাতে ৯ জন, আগুন ও বিস্ফোরণে ১২ জন, পানিতে ডুবে ৫ জন, মাটি বা দেয়াল ধসে ৮ জন এবং বিষাক্ত গ্যাসে ১ জনের মৃত্যু হয়েছে। অন্যান্য কারণে মৃত্যু হয়েছে আরও একজনের। এসআরএস মনে করে, এসব প্রাণহানির পেছনে রয়েছে অবকাঠামোগত দুর্বলতা, অনিয়ন্ত্রিত যানবাহন চালনা, ঝুঁকিপূর্ণ যন্ত্রপাতির ব্যবহার, নিরাপত্তা সরঞ্জামের অভাব, প্রশিক্ষণের ঘাটতি, মালিকপক্ষের গাফিলতি এবং দুর্ঘটনার পর জরুরি চিকিৎসার অনুপস্থিতি। অতিরিক্ত কাজের চাপ ও পর্যাপ্ত বিশ্রামের অভাবও শ্রমিক মৃত্যু বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে সংস্থাটি মনে করে। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক সেকেন্দার আলী মিনা বলেন, নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হলে খাতভিত্তিক দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নে মালিক, শ্রমিক ও সরকারের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রথম দায়িত্ব মালিকের, যিনি ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ এবং ব্যবহার নিশ্চিত করবেন। সরকারের দায়িত্ব হলো নিরাপত্তা বিধান প্রণয়ন এবং তা কঠোরভাবে বাস্তবায়নে তদারকি করা। অন্যদিকে, শ্রমিকদের দায়িত্ব মালিকের দেওয়া নির্দেশনা ও নিরাপত্তাবিধি মেনে চলা। জানা যায়, ২০২৪ সালের পুরো বছরে কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৭৫৮ জন শ্রমিক, যা ২০২৩ সালের ৮৭৫ জনের তুলনায় কিছুটা কম হলেও কাঠামোগত দুর্বলতা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘাটতি অপরিবর্তিত রয়েছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিআইএলএস)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ২২৯টি ঘটনায় শ্রমিক নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া গেছে, যার মধ্যে ১১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে ৭০৭ জন শ্রমিক কর্মস্থলে প্রাণ হারিয়েছেন বলে আরেকটি প্রতিবেদন জানায়। বাংলাদেশ অকুপেশনাল সেফটি, হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ফাউন্ডেশন (ঙঝঐঊ)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে কর্মস্থলে ১,৪৩২ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে, যা ২০২২ সালের তুলনায় ৪৮ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে ১,১০৩ জন ছিলেন অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত এবং ৩২৯ জন ছিলেন আনুষ্ঠানিক খাতে৫। বিশ্লেষকদের মতে, পরিবহন খাতে বারবার সর্বোচ্চ মৃত্যুর তালিকায় থাকায় এই খাতে নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা জরুরি। সড়ক কাঠামোর দুর্বলতা, অদক্ষ চালক, আইন প্রয়োগে বাধা এবং বেপরোয়া চালনা—এই সবই দুর্ঘটনার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। নির্মাণ খাতে নিরাপত্তা সরঞ্জামের অভাব, প্রশিক্ষণের ঘাটতি এবং অনুমোদনহীন স্থাপনা নির্মাণও মৃত্যুর হার বাড়িয়ে দিচ্ছে। এসআরএস ও ঙঝঐঊ উভয় সংস্থাই মনে করে, প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে, কারণ অনেক দুর্ঘটনার খবর গণমাধ্যমে আসে না। বিশেষ করে, রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় কর্মস্থলে যাওয়ার পথে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত শ্রমিকদের তথ্য অনেক সময় প্রতিবেদনভুক্ত হয় না। বাংলাদেশে কর্মস্থলে শ্রমিকের মৃত্যুর হার কমছে না- এটি শুধু পরিসংখ্যান নয়, বরং একটি কাঠামোগত ত্রুটির সংকেত। নিরাপত্তা সরঞ্জামের অভাব, প্রশিক্ষণের ঘাটতি এবং তদারকির দুর্বলতা- এই তিনটি বিষয়কে কেন্দ্র করে ত্রিপাক্ষিক সমন্বয় ছাড়া কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা রোধ সম্ভব নয়। নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হলে নীতিনির্ধারকদের দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। একই সঙ্গে শ্রমিকদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা, ক্ষতিপূরণ এবং পুনর্বাসন ব্যবস্থাও জোরদার করতে হবে।