১১:২৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই ২০২৫

জুলাই-আগস্ট গণহত্যা: শেখ হাসিনা, কামাল ও মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু

ডেস্ক নিউজ:
  • আপডেট সময়ঃ ০১:৫০:২৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই ২০২৫
  • / ১১ বার পড়া হয়েছে।

ছবি: সংগৃহীত

জুলাই-আগস্ট গণহত্যা: শেখ হাসিনা, কামাল ও মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক বিচার শুরুবাংলাদেশের ইতিহাসে আলোড়ন তোলা জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে বিচার শুরু হয়েছে। বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ এই আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

অভিযোগ গঠনের শুনানি ঘিরে এদিন সকালে গ্রেপ্তার অবস্থায় ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয় সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনকে। অন্যদিকে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল পলাতক থাকায় তাদের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন উপস্থিত ছিলেন। রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন তাদের মামলা থেকে অব্যাহতির আবেদন করলেও ট্রাইব্যুনাল সেটি খারিজ করে দেয়। ফলে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলো।

মামলার নথি অনুযায়ী, এই তিনজনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে। অভিযোগগুলোতে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের সময় সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে হত্যার উসকানি, নির্দেশ, সহায়তা এবং ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ছাত্র-জনতার ওপর পদ্ধতিগত আক্রমণ চালানো হয়েছিল। প্রসিকিউশন তাদের বক্তব্যে জানিয়েছে, এই হামলাগুলোতে মোট ১ হাজার ৪০০ জন নিহত হন।

প্রথম অভিযোগে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই গণভবনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন, যার পরপরই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসীরা নিরীহ ছাত্র-জনতার ওপর হামলা চালায়। সেই হামলায় হত্যা, হত্যার চেষ্টা, নির্যাতন এবং অন্যান্য অমানবিক আচরণ সংঘটিত হয়। শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনকে এই অপরাধের প্ররোচনা, সহায়তা এবং প্রতিরোধে ব্যর্থতার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা আন্দোলনরত জনতাকে হেলিকপ্টার, ড্রোন এবং প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে দমন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই নির্দেশ বাস্তবায়ন করেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল ও আইজিপি মামুন।

তৃতীয় অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্যের পর ১৬ জুলাই রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসীরা আক্রমণ চালায়। সেই আক্রমণে আন্দোলনকারী ছাত্র আবু সাঈদকে কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ড আসামিদের নির্দেশ, প্ররোচনা, সহায়তা এবং ষড়যন্ত্রের ফল বলেই অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।

চতুর্থ অভিযোগের ভিত্তিতে বলা হয়েছে, ৫ আগস্ট চাঁনখারপুল এলাকায় নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে ছয়জন নিহত হন। একই ধরনের আক্রমণ পঞ্চম অভিযোগে উঠে এসেছে, যেখানে ৫ আগস্ট আশুলিয়া এলাকায় নিরস্ত্র ছয়জন ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালিয়ে পাঁচজনকে হত্যা এবং একজনকে আগুনে পুড়িয়ে ফেলার অভিযোগ আনা হয়েছে। এই ঘটনাগুলোকেও আসামিদের নির্দেশ, প্ররোচনা ও ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে প্রসিকিউশন।

অভিযোগপত্রটি বিশাল আকারের। প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্রের মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা আট হাজার সাতশো সাতচল্লিশ। এর মধ্যে তথ্যসূত্র দুই হাজার আঠারো পৃষ্ঠা, জব্দতালিকা ও অন্যান্য দালিলিক প্রমাণাদি চার হাজার পাঁচ পৃষ্ঠা এবং শহীদদের তালিকার বিবরণ দুই হাজার সাতশো চব্বিশ পৃষ্ঠা। মামলায় মোট ৮১ জন সাক্ষী রয়েছেন।

এই মামলায় শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল এখনও পলাতক রয়েছেন। চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন কারাগারে আটক আছেন।

অপরদিকে, চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ট্রাইব্যুনালে রাজসাক্ষী হতে চেয়েছেন এবং আদালতে নিজের দায় স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, “জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডে আমি জড়িত। আমি দায়ী।” তার এই স্বীকারোক্তি মামলার বিচার প্রক্রিয়ায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে এই প্রথম বাংলাদেশের কোনো সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রী আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়ালেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মামলার রায় বাংলাদেশের রাজনীতি এবং সমাজে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।

নিউজটি শেয়ার করুন
ট্যাগসঃ

বিস্তারিত লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষণ করুন

আপলোডকারীর তথ্য

জুলাই-আগস্ট গণহত্যা: শেখ হাসিনা, কামাল ও মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু

আপডেট সময়ঃ ০১:৫০:২৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই ২০২৫

জুলাই-আগস্ট গণহত্যা: শেখ হাসিনা, কামাল ও মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক বিচার শুরুবাংলাদেশের ইতিহাসে আলোড়ন তোলা জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে বিচার শুরু হয়েছে। বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ এই আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

অভিযোগ গঠনের শুনানি ঘিরে এদিন সকালে গ্রেপ্তার অবস্থায় ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয় সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনকে। অন্যদিকে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল পলাতক থাকায় তাদের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন উপস্থিত ছিলেন। রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন তাদের মামলা থেকে অব্যাহতির আবেদন করলেও ট্রাইব্যুনাল সেটি খারিজ করে দেয়। ফলে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলো।

মামলার নথি অনুযায়ী, এই তিনজনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে। অভিযোগগুলোতে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের সময় সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে হত্যার উসকানি, নির্দেশ, সহায়তা এবং ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ছাত্র-জনতার ওপর পদ্ধতিগত আক্রমণ চালানো হয়েছিল। প্রসিকিউশন তাদের বক্তব্যে জানিয়েছে, এই হামলাগুলোতে মোট ১ হাজার ৪০০ জন নিহত হন।

প্রথম অভিযোগে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই গণভবনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন, যার পরপরই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসীরা নিরীহ ছাত্র-জনতার ওপর হামলা চালায়। সেই হামলায় হত্যা, হত্যার চেষ্টা, নির্যাতন এবং অন্যান্য অমানবিক আচরণ সংঘটিত হয়। শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনকে এই অপরাধের প্ররোচনা, সহায়তা এবং প্রতিরোধে ব্যর্থতার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা আন্দোলনরত জনতাকে হেলিকপ্টার, ড্রোন এবং প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে দমন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই নির্দেশ বাস্তবায়ন করেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল ও আইজিপি মামুন।

তৃতীয় অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্যের পর ১৬ জুলাই রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসীরা আক্রমণ চালায়। সেই আক্রমণে আন্দোলনকারী ছাত্র আবু সাঈদকে কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ড আসামিদের নির্দেশ, প্ররোচনা, সহায়তা এবং ষড়যন্ত্রের ফল বলেই অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।

চতুর্থ অভিযোগের ভিত্তিতে বলা হয়েছে, ৫ আগস্ট চাঁনখারপুল এলাকায় নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে ছয়জন নিহত হন। একই ধরনের আক্রমণ পঞ্চম অভিযোগে উঠে এসেছে, যেখানে ৫ আগস্ট আশুলিয়া এলাকায় নিরস্ত্র ছয়জন ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালিয়ে পাঁচজনকে হত্যা এবং একজনকে আগুনে পুড়িয়ে ফেলার অভিযোগ আনা হয়েছে। এই ঘটনাগুলোকেও আসামিদের নির্দেশ, প্ররোচনা ও ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে প্রসিকিউশন।

অভিযোগপত্রটি বিশাল আকারের। প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্রের মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা আট হাজার সাতশো সাতচল্লিশ। এর মধ্যে তথ্যসূত্র দুই হাজার আঠারো পৃষ্ঠা, জব্দতালিকা ও অন্যান্য দালিলিক প্রমাণাদি চার হাজার পাঁচ পৃষ্ঠা এবং শহীদদের তালিকার বিবরণ দুই হাজার সাতশো চব্বিশ পৃষ্ঠা। মামলায় মোট ৮১ জন সাক্ষী রয়েছেন।

এই মামলায় শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল এখনও পলাতক রয়েছেন। চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন কারাগারে আটক আছেন।

অপরদিকে, চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ট্রাইব্যুনালে রাজসাক্ষী হতে চেয়েছেন এবং আদালতে নিজের দায় স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, “জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডে আমি জড়িত। আমি দায়ী।” তার এই স্বীকারোক্তি মামলার বিচার প্রক্রিয়ায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে এই প্রথম বাংলাদেশের কোনো সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রী আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়ালেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মামলার রায় বাংলাদেশের রাজনীতি এবং সমাজে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।

নিউজটি শেয়ার করুন