ঢাবি শিক্ষার্থী সাঞ্জুর মৃত্যু: চা-বাগানের স্বপ্ন থেমে গেল ছাদের কিনারে

- আপডেট সময়ঃ ১২:০৪:১৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই ২০২৫
- / ১১ বার পড়া হয়েছে।

হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার আমু চা-বাগানের সন্তান সাঞ্জু বাড়াইক ছিলেন শুধু একটি নাম নয়-একটি স্বপ্ন, একটি প্রতীক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) নৃবিজ্ঞান বিভাগের এই মেধাবী শিক্ষার্থী সোমবার (১৪ জুলাই) ভোরে জগন্নাথ হলের ছাদ থেকে পড়ে মারা যান। তার অকাল মৃত্যু কেবল একটি পরিবারকেই নয়, কাঁদিয়ে তুলেছে পুরো বাগানপাড়া, এক সমাজ, এক শ্রেণির লড়াকু মানুষের আশা।
রাতের ছাদ, ভোরের লাশ
সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, রাত ৪টা ১০ মিনিটে সাঞ্জু জগন্নাথ হলের ছাদে ওঠেন। এরপর প্রায় দেড় ঘণ্টা পর, ভোর ৫টা ৩০ মিনিটে, তাকে হল সংলগ্ন সড়কে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। শুরুতে তার পরিচয় নিশ্চিত না হলেও, পকেটে পাওয়া একটি প্রশ্নপত্র দেখে পুলিশ তাকে শনাক্ত করে। পরে সহপাঠীরাও নিশ্চিত করেন- তিনি সাঞ্জু বাড়াইক।
জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক দেবাশীষ পাল জানান, “সাঞ্জু কিছুদিন ধরে মানসিক চাপে ছিল। হলে থাকত না, বাইরে থাকত। আমরা খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যাই। কিন্তু ঢাকা মেডিকেলে নেওয়ার পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
স্বপ্ন থেমে গেল যেভাবে
সাঞ্জু ছিলেন ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। চা-শ্রমিক পরিবার থেকে উঠে আসা এই তরুণের স্বপ্ন ছিল বড়। মা অনিমা বাড়াইক বলেন, “আমার ছেলেটা অনেক কষ্ট কইরা পড়ছিল। কয়দিন আগে ফোন কইয়া কইল- ‘মা, চাকরি করুম, আর তোকে কষ্ট করতে হবে না’। এখন সেই ছেলেটা আইলো না, লাশ আইলো। তিনি জানান, প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা চা-বাগানে কাজ করে সাঞ্জুর পড়াশোনার খরচ চালিয়েছেন। পিতা মনিরোদ বাড়াইক স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের গ্রাম পুলিশ। তিনি বলেন, ছেলেটা কোনোদিন মন্দ পথে যায়নি। ওর স্বপ্ন ছিল, অফিসার হবে, সমাজ বদলাবে। এখন সব স্বপ্ন শেষ।
সে ছিল আমাদের অহংকার’
সাঞ্জুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বিজয় হাজরা বলেন, ও-ই প্রথম আমাদের বাগান থেকে ঢাবিতে সুযোগ পেয়েছিল। ও ছিল আমাদের অহংকার। স্থানীয় শিক্ষক সোহাগ মিয়া বলেন, সমাজে যদি একজন মেধাবী তরুণ এভাবে ঝরে যায়, তাহলে দায় শুধু তার নয়-আমাদের সবার। সময়মতো যদি পাশে কেউ দাঁড়াত.হয়তো এই মৃত্যু হতো না।
সহপাঠীর চোখে সাঞ্জু
বন্ধু শুভ রুদ্র বলেন, “কয়েকদিন ধরে সাঞ্জু খুব চুপচাপ ছিল। কারও সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলত না। বুঝতে পারছিলাম, ওর ভেতরে দহন চলছিল।” আরেক সহপাঠী জানান, “সে সবসময় পরিবার নিয়ে ভাবত। বলত, খরচ বাঁচাতে বাড়ি যাওয়া যাবে না। ঢাকায় থেকেও যেন বাগানের মাটির গন্ধ লেগে থাকত ওর ভেতরে।
শেষ ফেসবুক পোস্টে ছিল আত্মগ্লানি মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে (রাত ১২টা ৮ মিনিটে) সাঞ্জু তার ফেসবুকে লেখেন: আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। দিনের পর দিন কাউকে ডিস্টার্ব করেছি, মানুষকে দোষারোপ করেছি। আমি ক্ষমাপ্রার্থী। আমার কারণে কারও ক্ষতি হয়ে থাকলে আমি দুঃখিত। আমি সকলের কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। পোস্টটি ছিল হতাশায় ভরা। এরপরই ঘটে মর্মান্তিক ঘটনাটি। এটি আত্মহত্যা নাকি দুর্ঘটনা- সেটি এখনও তদন্তাধীন।
আত্মহত্যা নাকি দুর্ঘটনা?
চুনারুঘাট থানার ওসি মো. নুর আলম বলেন, ঢাবি কর্তৃপক্ষ আমাদের বিষয়টি আত্মহত্যা হিসেবে জানিয়েছে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকার তদন্ত প্রতিবেদন এবং মৃত্যুর কারণ জানতে অপেক্ষা করছি। আহম্মদাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাকির হোসেন পলাশ বলেন, “চার ভাইয়ের মধ্যে সাঞ্জু ছিল দ্বিতীয়। বড় ভাই অটো রিকশা চালায়। সাঞ্জুর মৃত্যু শুধু পরিবার নয়, পুরো ইউনিয়নের অপূরণীয় ক্ষতি। সাঞ্জুর পিতা আমাদের ইউনিয়নেরই একজন গ্রাম পুলিশ। আমি ব্যক্তিগতভাবে পরিবারটির পাশে আছি।
যেখানে থেমেছে জীবন, সেখানেই থেমেছে স্বপ্ন’
সাঞ্জুর মৃত্যুতে আমু চা-বাগান নিস্তব্ধ। কাঁদছে বন্ধুরা, শিক্ষকরা, বাগানের শ্রমিকরা। স্থানীয় বাসিন্দা অনিল বাড়াইক বলেন, “ও ছিল ভবিষ্যতের আলো। এখন সব অন্ধকার। মঙ্গলবার বিকেলে ময়নাতদন্ত শেষ হয়। রাতেই মরদেহ পৌঁছানোর কথা রয়েছে।
এক বন্ধুর বিদায়ী চিঠি
সাঞ্জুর বন্ধু রানা রিকসন আবির লিখেছেন: “সাঞ্জু, তুই শুধু কি আমার বন্ধু ছিলি? নিজের ভাই ছিলি। পাঁচ বছর একসাথে চলেছি। অনেক অভিমান, বিরাগ- শেষে আবার মিল হয়েছিল। তখন জড়িয়ে ধরে তুই কান্না করেছিলি। এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না, তুই আর আমাদের মাঝে নেই। ভালো থাকিস, ভাই। পরপারে শান্তিতে থাকিস।
আমরা কি পাশে ছিলাম?
চুনারুঘাট সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী কামরুল হাসান বলেন, “সাঞ্জুর মৃত্যু আমাদের প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়- এই সমাজ কি তার মতো মেধাবীদের মানসিকভাবে বাঁচিয়ে রাখতে পারে? যে ছেলেটি চা-বাগান থেকে ঢাবি পর্যন্ত পৌঁছেছিল, সে হেরে গেল একা একা। সাঞ্জুর মৃত্যু আমাদের মনে করিয়ে দেয়- মানসিক স্বাস্থ্য কোনো একক ব্যক্তির বিষয় নয়, বরং এটি একটি সামাজিক দায়। এখন সময়, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পরিবার ও সমাজকে আরও যত্নবান হওয়ার।