পাথরের পর এবার বালুতে হাত মিলেমিশে উত্তোলন-চাঁদাবাজি

- আপডেট সময়ঃ ০২:৩০:৫৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৮ জুলাই ২০২৫
- / ৫২ বার পড়া হয়েছে।

নদীর নাম সুনাই, কেউ বলেন বাইরং নদী। ছোট এ নদীর অবস্থান সুনামগঞ্জের ছাতক ও সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায়। দুই উপজেলার মধ্যবর্তী কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে রয়েছে প্রচুর বালু। নদীসহ পাশের বন বিভাগের জায়গাকে ঘিরে দীর্ঘদিন ধরে চলছে বালু উত্তোলনের উৎসব। মাঝেমধ্যে বন্ধ হলেও প্রতি মৌসুমে সেখানে হাত বাড়ায় বালুখেকোরা। এবারও নদী তীরবর্তী বাসিন্দারা মিলেমিশে বালু তুলছে। এ কাজের সুযোগ করে দিয়ে রাজনৈতিক দলের নেতারা করছেন চাঁদাবাজি।
শুধু সুনাই নয়, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ধলাই নদীর ইজারাবহির্ভূত জায়গা থেকেও শুরু হয়েছে বালু উত্তোলন। গত শুক্রবার ধলাই নদীর দক্ষিণ বালুমহালটি ৯ কোটি টাকায় ইজারা দিয়েছে জেলা প্রশাসন। সরেজমিন দেখা গেছে, নদীর ইজারার সীমানার বাইরের বাঙ্কার ও রজ্জুপথ (রোপওয়ে) এলাকায় গর্ত করে বালু তুলছেন শ্রমিকরা।
ধলাই নদী বালুমহালের ইজারাদার আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, শুক্রবার কার্যাদেশ পেয়েছেন। ওই দিন টোল আদায় করতে গেলে একটি মহল বাধা সৃষ্টি করে। আজকালের মধ্যে তাঁকে মহাল সরেজমিন বুঝিয়ে দেওয়া হবে। সুনাই নদীর নতুন জালিয়ারপাড় এলাকায় দেখা যায়, নৌকা শ্রমিকরা নির্বিঘ্নে বালু তুলে নদী তীরে মজুত করছেন। সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন ‘মহাজন’, যারা নিয়ন্ত্রণ করেন শ্রমিকদের। আমবাড়ি এলাকার বারকি শ্রমিক মনজুর জানান, নদী থেকে বালু তোলার জন্য কাউকে টাকা দিতে হয় না। তবে তীরে মজুত করে বিক্রি করলে টাকা দিতে হয়। একই দৃশ্য দেখা গেল ছনবাড়ি অংশে। সেখানে নদী থেকে তীরে বালু তোলার সুবিধার জন্য ট্রাকের রাস্তা করা হয়েছে। সেই রাস্তার নাম করে এক হাজার টাকা করে আদায় করছেন বালু নিয়ন্ত্রকরা। এই টাকার মধ্যে আবার জায়গার মালিক (যদিও নদী) দাবিদার ৩০০ টাকা করে নেন। বাকি ৭০০ টাকা করা হয় ভাগবাটোয়ারা।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সিলেটে পাথররাজ্যে লুটপাট শুরু হয়। সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে অনেক জায়গা থেকে পাথর উত্তোলন বন্ধ হয়ে যায়। তবে এখনও কোম্পানীগঞ্জের শারফিন টিলা থেকে পাথর লুটপাট চলছে। পাথর লুট কমে যাওয়ার পর হাত পড়েছে বালুতে। জেলা প্রশাসন গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুর উপজেলার সাতটি মহাল ইজারা দিলেও অন্তত ২০টি মহাল ও স্থান থেকে প্রতিদিন লাখ লাখ ঘনফুট বালু তোলা হচ্ছে। ছাতকের বৈশাকান্দি ও বাহাদুরপুর এলাকায় সুনাই নদীর বালু উত্তোলন চলছে।
ইসলামপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও জামায়াত নেতা সুফি আলম সোহেলের বিরুদ্ধে ছাতক অংশে বালু উত্তোলন নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ উঠেছে। কোম্পানীগঞ্জ অংশ নিয়ন্ত্রণ করছেন উপজেলা বিএনপি নেতা আজির উদ্দিন ও ইসলামপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি ইসমাইল আলী। এতে উভয় অংশের নোয়াকোট, বাহাদুরপুর, গাংপার, জালিয়ারপাড়ের মখলিছ মিয়া, দুলাল মিয়া, রতন মিয়া, সুজন মিয়াসহ অনেকে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
ইউপি চেয়ারম্যান সুফি আলম বলেন, ‘যারা বালু উত্তোলনে জড়িত, তারাই আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে। এক সময় আওয়ামী লীগের লোকজন জড়িত ছিল, এখন মিলেমিশে করা হচ্ছে।’ বিএনপি নেতা আজির উদ্দিন বলেন, ‘সুনাই নদীর ছাতকের অংশে সেখানকার লোক জড়িত। আমরা কেউ জড়িত না।’
এদিকে পাথর তোলায় ভোলাগঞ্জের রেলের সংরক্ষিত বাঙ্কার এলাকা ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন বালু উত্তোলন চলছে। ধলাই নদীর ওপর নির্মিত সেতু ও সুনাই নদীর রাবার ড্যাম হুমকির মুখে পড়েছে।
সোনাই নদীর পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতির সভাপতি আব্দুল জব্বার খোকন জানান, বালু উত্তোলনের ফলে রাবার ড্যাম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ছাতক বন বিটের কর্মকর্তা আইয়ুব খান জানান, বালু উত্তোলন ঠেকানো যাচ্ছে না। জনবল কম থাকায় সব সময় অভিযান সম্ভব হয় না।
কোম্পানীগঞ্জের উৎমাছড়া, কুলিছড়া ও মনুরগাঙ এলাকা থেকে বালু উত্তোলন ও চাঁদাবাজিতে উৎমা অংশে জেলা যুবদল নেতা মোস্তাকিম আহমদ ফরহাদ, চরারবাজার ব্যবসায়ী এনামুল হক এনাম, শ্রমিল দল নেতা উসমান মিয়া, আলা উদ্দিন, কুলিছড়ায় আওয়ামী লীগের কামাল হোসেন রয়েছেন।
এদিকে জৈন্তাপুরের ৪ নম্বর বাংলা বাজার, আসামপাড়া, শ্রীপুর, গাতিগ্রাম, বাওনহাওর, শেওলারটুকে বোমা মেশিন ও ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু তোলা হচ্ছে। পিয়াইন নদী ইজারা হলেও বালু উত্তোলন চলছে চাতলার ঢালা এলাকা থেকে। এ ছাড়া গোয়াইনঘাটের সব ইউনিয়ন পরিষদের উন্নয়নের নামে বালুবাহী নৌকা থেকে দুই-তিন হাজার টাকা করে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে।
জানতে চাইলে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাহাব উদ্দিন বলেন, ‘দলের কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
গোয়াইনঘাট থানার ওসি সরকার তোফায়েল আহমদ জানান, ইউনিয়ন পরিষদের নামে চাঁদা আদায়ের বিষয়টি শুনেছেন। কিন্তু কোনো অভিযোগ পাননি।
সিলেট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বলেন, বালু ও পাথর উত্তোলনের বিরুদ্ধে প্রশাসন মাঠে রয়েছে। জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বালু উত্তোলন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। সুত্র: সমকাল