সংকট, প্রতিকূলতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, শ্রমিক অসন্তোষ– সময়ের সবচেয়ে কঠিন প্রতিবন্ধকতার মুখেও শ্রমিক-মালিকের হাত ধরে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে মৌলভীবাজারের ৯২টি চা বাগান।
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সবুজ পাহাড় ও ঘন বনভূমির মাঝে অবস্থিত চায়ের রাজধানীখ্যাত শ্রীমঙ্গল উপজেলা। এখানকার চা বাগানগুলো দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে শতাব্দী ধরে। চা শ্রমিকদের শ্রম আর ত্যাগের সঙ্গে ভেঙে পড়া এই খাতে নতুনদের লড়াকু মানসিকতায় ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছে এই শিল্প।
চা বোর্ডের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত বছর রপ্তানি বাড়লেও দুই যুগ আগে রপ্তানিতে যে জৌলুস ছিল তা এখনও ফেরেনি চা শিল্পে। স্বাধীনতার পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রপ্তানি পণ্য ছিল এই চা। দেশের প্রধান চা উৎপাদন মৌসুম জুন থেকে নভেম্বর। বর্তমানে দেশের বার্ষিক চাহিদার সাড়ে আট কোটি কেজি থেকে ৯ কোটি কেজির মধ্যে এখানেই উৎপাদিত হয় সিংহভাগ। বাকিটুকু রপ্তানি হচ্ছে।
চা বোর্ডের দেওয়া তথ্যমতে, দেশে সমতল ও পাহাড় মিলে চা বাগানের সংখ্যা ১৬৭টি। এর মধ্যে বেশি চা বাগান রয়েছে মৌলভীবাজার জেলায়। এখানেই রয়েছে ৯২টি বাগান। আর বাগানগুলোতে চা চাষের আওতাধীন ৮৫ হাজার ৫৪১ দশমিক ৬২ একর জমি। দেশের মোট চা উৎপাদনের প্রায় ৭৫ শতাংশ আসে এ অঞ্চল থেকে।
সর্বশেষ ২০২৪ সালে ৯ কোটি ৩০ লাখ কেজি চা উৎপাদন হয়েছে মৌলভীবাজার জেলায়। বছরের পর বছর এসব চা বাগানে কর্মরত ৮৬ হাজার চা শ্রমিক দেশের অর্থনীতিতে রেখে যাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। চলতি বছর এ জেলায় চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১০৩ মিলিয়ন কেজি।
শ্রীমঙ্গলের চা নিলাম বাজারের সর্বশেষ নিলামটি হয়েছিল গত ২৫ জুন। যেখানে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম নিলাম অনুষ্ঠিত হয়। এই নিলামে পাঁচটি ব্রোকার হাউসের ১ লাখ ২৫ হাজার ৩৩ কেজি চা নিলামে উঠেছিল। যার আনুমানিক মূল্য ৩ কোটি ৭ লাখ ৭ হাজার টাকা। নিলামে সর্বোচ্চ দরে বিক্রি হয়েছে গ্রিনলিফ চা বাগানের গ্রিন টি ১ হাজার ৪৫০ টাকা কেজি। ন্যাশনাল টি কোম্পানির পার্থখলা ও প্রেমনগর বাগানের ব্ল্যাক-টি বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ২৭১ টাকা।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষ নিলাম পর্যন্ত শ্রীমঙ্গল চা নিলাম কেন্দ্রে মোট অফারিং ছিল ১৩ লাখ ২৯ হাজার ১২১ দশমিক ৬০ কেজি চা। যার মধ্যে বিক্রি হয়েছে ১১ লাখ ৪৮ হাজার ৮৯৩ দশমিক ১০ কেজি চা। অবিক্রীত ১ লাখ ৮০ হাজার ২২৮ দশমিক ৫০ কেজি। বিক্রীত চায়ের গড় মূল্য ছিল প্রায় ১৭৫ টাকা কেজি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষ নিলামে তিনটি ব্রোকার হাউসের ১ লাখ ৩২ হাজার ১১৯ দশমিক ৬০ কেজি চা নিলামে উঠেছিল। এর মধ্যে বিক্রি হয় মাত্র ৪২ হাজার ১৮৪ দশমিক ১০ কেজি চা। যার গড় মূল্য ছিল ২০৮ টাকা ৬০ পয়সা। সর্বশেষ নিলামে বিক্রির হার পতনের মুখে বাজারে চায়ের মাথা তোলার প্রয়াস দৃশ্যমান। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুর্নীতি ও অনিয়মের লাগাম টানার চেষ্টা করছেন তারা। এটা মূলত তারই ফসল।
বাণিজ্যিকভাবে অবস্থার পরিবর্তনের আভাস দিলেও এর ছোঁয়া লাগেনি স্থানীয় চা শ্রমিকদের জীবনে। ২০০ বছরে তাদের দৈনিক মজুরি হয়নি ২০০ টাকাও। তবু এই সবুজের মায়ায় জড়িয়ে পড়া মানুষ লড়াই অব্যাহত রেখেছেন। পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা পর্ষদ বলছে, এই ভালোবাসার প্রতিদানও শ্রমিকদের নিশ্চিত করতে চান তারা। ২০২২ সালে চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ছিল ১২০ টাকা। দীর্ঘ সংগ্রামের পর বিগত সরকারের হস্তক্ষেপে সেটা ১৭০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
২০২৩ সালের আগস্টে শ্রম মন্ত্রণালয় বিচার বিভাগভিত্তিক মজুরি ধার্য করে এ-ক্যাটেগরি ১৭০ টাকা, বি-১৭০ এবং সি-১৬৮ থেকে ১৬৯ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। এর পরও তাদের জীবনযাত্রার মান কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পৌঁছেনি।
দীর্ঘ সময় বাংলাদেশ চা উৎপাদনে পিছিয়ে ছিল। এক দশক আগেও দেশে চা উৎপাদন হতো ছয় কোটি কেজির কিছু বেশি। তবে ধারাবাহিকভাবে উৎপাদন বাড়ার কারণে দেশে চা উৎপাদনের পরিমাণ ১০ কোটি কেজি অতিক্রম করেছিল ২০২৩ সালে, যা এক বছর বাদে আবার নেতিবাচক ধারায় চলে যায়। চা বোর্ডের তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালে ৯ কোটি ৩০ লাখ কেজি চা উৎপাদন হয়েছে। অর্থাৎ আগের বছরের চেয়ে উৎপাদন কমেছে প্রায় ৯৯ লাখ কেজি।
তবে স্বস্তির খবর, একই সময়ে (২০২৩ থেকে ২৪) চায়ের রপ্তানি দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে চা রপ্তানি হয়েছিল ১০ লাখ ৪ হাজার কেজি, যা পরের বছর ২৪ লাখ ৫০ হাজার কেজিতে পৌঁছায়। গত বছর ১৯টি দেশে রপ্তানি করা হয়েছে ওইসব চা। রপ্তানির তালিকায় যুক্ত হয়েছে কয়েকটি নতুন দেশ।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মাখন লাল কর্মকার বলেন, এখন চা শ্রমিকদের মূল দাবি– তাদের ভূমি অধিকার এবং ২০ মে রাষ্ট্রীয়ভাবে চা-শ্রমিক দিবস হিসেবে স্বীকৃতি।
এ ব্যাপারে জেরিন চা বাগানের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার সেলিম রেজা বলেন, চায়ের রাজধানী মৌলভীবাজারে বাড়ছে বাগানের আয়তন। চা উৎপাদন বাড়াতে উৎসাহিত করছে সরকার। এ জন্য বাগান মালিকরাও তাদের অনাবাদি জমিতে নতুন চারা রোপণ শুরু করেছেন। বাগানের গাছের পরিচর্যার মাধ্যমে উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত আছে।
শ্রী গোবিন্দপুর চা বাগান ও ন্যাশনাল টি কোম্পানির পরিচালক মহসীন মিয়া মধু বলেন, অমিত সম্ভাবনার অনুপাতে অনেকটা অর্জিত না হলেও এ শিল্পের অর্জন একেবারে কম নয়। বিটিআরআই উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞান চা শিল্পে জেনেটিক মোডিফিকেশন ও মাইক্রোপোপাগেশনের মাধ্যমে চায়ের ক্লোন চারা রোপণে উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাশাপাশি সার, কীটনাশকসহ সবকিছুর দাম বাড়লেও চায়ের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে না। এতে চা বাগান পরিচালনা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশন-সিলেট ব্রাঞ্চের চেয়ারম্যান জিএম শিবলী বলেন, চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখে মৌলভীবাজার জেলা দেশের চা উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। জেলার প্রায় সব উপজেলায় ছোট-বড় চা বাগান রয়েছে। চা উৎপাদনে পরিবেশগত সুবিধা থাকায় এবং বাগান মালিকদের আন্তরিকতায় প্রতিবছর সর্বোচ্চ পরিমাণ চা উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে।
বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ইসমাইল হোসেন জানান, এই ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি ও গুণগত মান রক্ষায় নানা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এখন উৎপাদন মৌসুম শুরু হয়েছে। চা বোর্ড চেয়ারম্যানের নির্দেশে চা গবেষণা কেন্দ্রের সব কর্মকর্তা মাঠে কাজ করছেন।
চা বোর্ডের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও উপসচিব সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, কর্তৃপক্ষ চায় বাংলাদেশের চা শিল্প রক্ষা পাক। দেশের উৎপাদিত চায়ের মান উন্নত হোক এবং অবৈধ আমদানি ও বাজারজাতকরণের মাধ্যমে যেন দেশের চা শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। চা বোর্ডের নজর সেদিকে রয়েছে।
প্রধান সম্পাদকঃ আবুবকর সিদ্দিক সুমন। নির্বাহী সম্পাদকঃ রুবেল হাসনাইন। বার্তা সম্পাদকঃ রুমি বরুয়া।
গুলশান, ঢাকা-১২১৬, বাংলাদেশ। ইমেইলঃ admin@sylhet21.com,sylhet21.com@gmail.com মোবাইলঃ +1586 665 4225
©২০২৫ সিলেট ২১ সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত। | Developed Success Life IT