প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও পৃষ্ঠপোষকতা, ২৬ মে ধামাইল দিবস ও মরমি কবি রাধারমণ দত্ত

- আপডেট সময়ঃ ১০:৫০:২৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৬ মে ২০২৫
- / ৪৪ বার পড়া হয়েছে।

সুহেল ইবনে ইসহাক :
পূর্ব বাংলার সিলেট অঞ্চলের অন্যতম প্রচলিত এক লোক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান “ধামাইল”। বিশেষ ধরনের সঙ্গীতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিশেষ ভঙ্গিমার এই নৃত্য বিয়ে, অন্নপ্রাশনসহ সকল মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে পরিবেশনের রীতি রয়েছে সিলেট অঞ্চলে।
বাংলাদেশের সিলেট এলাকার পাশাপাশি ভারতে ত্রিপুরা রাজ্যের উত্তরাঞ্চল, আসামের কাছাড়, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দিসহ দক্ষিণ আসাম ও উজান আসামের যে সব অঞ্চলে সিলেটি অংশের মানুষের বাস সেসব এলাকায় ধামাইলের প্রচলন রয়েছে।

অনেকের মতে “ধামা” শব্দ থেকে “ধামাইল” কথাটির উৎপত্তি, আবার আসামের কাছাড়ের দিকে হাসি-ঠাট্টাকে “ধেমালি” বলা হয়। আবার ধামাইলের অনেক গানে মজা কৌতুকের কথা থাকে, গান গাওয়ার সময় এক দল অন্য দলকে কৌতুকের ছলে গান গেয়ে ব্যাঙ্গ করে তখন অপর দল আবার গান গেয়ে পাল্টা উত্তর দেয়। এ থেকে ধামাইল নামের উৎপত্তি বলে অনেকে মনে করেন।
অপরদিকে “ধামা” শব্দটি থেকে “ধামালি” বা “ধামাইল” শব্দটির উৎপত্তি; এর অর্থ আবেশ/ভাব। শুদ্ধ উচ্চারণ “ধামালি” এর সিলেটের আঞ্চলিক উচ্চারণ “ধামাইল”ই বেশি প্রচলিত ও জনপ্রিয় (যেমন, সিলেট অঞ্চলে শুদ্ধ উচ্চারণ ”গালি” এর আঞ্চলিক উচ্চারণ “গাইল, অর্থাৎ গালি >গাইল, ঠিক তেমনি ধামালী > ধামাইল)। আবার, আঞ্চলিক / কথ্য হিসেবে এর অর্থ উঠোন। ধারণা করা হয়, রাধারমণ দত্ত ভাবুক প্রকৃতির হওয়ায় এই জাতীয় নামের উৎপত্তি হয়েছে। আবার অনেকের মতে, বাড়ীর উঠোনে এই গান – নাচের আয়োজন করা হয় বলে একে “ধামাইল গান / নাচ” বলে।
ছবি-৩: দর্শকপ্রিয় সেই ধামাইল নাচ
ধামাইলের প্রায় গানের কলিতে “ভাইবা রাধারমণ’ শব্দবন্দের উল্লেখ রয়েছে। তাই রাধারমণ দত্তকে ধামাইল গানের মূল রচয়িতা বলে মতামত ব্যক্ত করেন ত্রিপুরার লোকশিল্পী অমিত আচার্য। বিশেষ অঙ্গভঙ্গিতে বৃত্তাকারভাবে নেচে নেচে ধামাইল গান গাওয়া হয়। আবার গানের তালের সঙ্গে সঙ্গে নৃত্যের ভঙ্গিমা ও গতি বদল হয়। ধামাইল গানের ব্যবহৃত গুরুত্বপূর্ণ বাদ্যযন্ত্র ঢোল। প্রথমে একজন গানের কলি গেয়ে শুরু করেন তারপর সঙ্গী অন্যান্য নারীরা গেয়ে ওঠেন। প্রথমে গান কিছুটা ধীর গতিতে শুরু হলেও আস্তে আস্তে নৃত্যগীতের গতি বাড়তে থাকে। “ধামাইল গান” ও “ধামাইল নাচ” বাংলাদেশের ময়মনসিংহ এবং সিলেট অঞ্চলের বিশেষ করে সুনামগঞ্জে প্রচলিত একজাতীয় কাহিনী সংবলিত মূলত নারীদের আচারকেন্দ্রিক বাংলা লোকগান এবং লোকনৃত্য, যা এই অঞ্চলসমূহের লোকসাহিত্যের একটি অংশ। আর এই “ধামাইল গান” এর প্রবর্তক বা জনক হলেন বাংলা সাহিত্যিক, সাধক কবি, বৈঞ্চব বাউল, বাউল সাধক রাধারমণ দত্ত পুরকায়স্থ । তিনি দেহতত্ত্ব, ভক্তিমূলক, অনুরাগ, প্রেম, ভজন, ধামাইলসহ নানা ধরনের কয়েক হাজার গান রচনা করেছেন।
রাধারমণ দত্ত পুরকায়স্থ (১৮৩৩ – ১৯১৫) একজন বাংলা সাহিত্যিক, সাধক কবি, বৈঞ্চব বাউল, ধামালি নৃত্য-এর প্রবর্তক। সংগীতানুরাগীদের কাছে তিনি “রাধারমণ” বলেই সমাধিক পরিচিত। বাংলা লোকসংগীতের পুরোধা লোককবি রাধারমণ দত্ত। তার রচিত ধামাইল গান বাংলাদেশ ও ভারতের বাঙালিদের কাছে প্রিয়।
রাধারমণ দত্তের জন্ম ১৮৩৩ সালে, জগন্নাথপুরের খ্যাতিমান ও প্রভাবশালী এক পরিবারে। তার পূর্বপুরুষদের নামে যেখানে তিনটি এলাকার নাম আছে। এলাকাগুলো হলো জগন্নাথপুর, প্রভাকরপুর ও কেশবপুর। কেশবপুরেই তৎকালীন খ্যাতিমান সাহিত্যিক ও কবি রাধামাধব দত্ত পুরকায়স্থের ঘরে জন্ম নেন রাধারমণ দত্ত। তার মায়ের নাম সুবর্ণা দেবী। বৈষ্ণব-সহজিয়া দর্শনে দীক্ষিত তার বাবা ছিলেন বাংলা ও সংস্কৃত ভাষার বড়মাপের পণ্ডিত। তার বাবার লেখা সহজিয়া গানগুলোও ছিলো চমৎকার। তিনি বাংলা ও সংস্কৃত ভাষার কবি ও অনুবাদকও ছিলেন। মহাকবি জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ কাব্যের স্বচ্ছন্দ টীকাভাষ্য রচনা করেন তিনি। বাংলা ভাষায় ‘কৃষ্ণলীলার গীতিকাব্য’, ‘পদ্মপুরাণ’, ‘সূর্যব্রত পাঁচালী’, ‘গোবিন্দ ভোগের গান’ প্রভৃতি বই তার লেখা।
তাছাড়াও সংস্কৃত ভাষায় তিনি কয়েকটি বই লিখেছিলেন, যার মধ্যে ‘ভারত সাবিত্রী’ ও ‘ভ্রমরগীতিকা’ উল্লেখযোগ্য। পিতার সংগীত ও সাহিত্য সাধনা শিশু রাধারমণকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। রাধারমণ দত্তরা ছিলেন তিন ভাই। ভাইদের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। রাধারমণ মাত্র ১০ বছর বয়সে পিতৃহারা হন। সেই থেকে মা সুবর্ণা দেবীর আদর-যত্নে বেড়ে ওঠেন তিনি।
পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে তিনি বিয়ে করেন মৌলভীবাজার জেলার সদর উপজেলার আদপাশা গ্রামের নন্দকুমার সেন অধিকারীর কন্যা গুণময়ী দেবীকে। রাধারমণ-গুণময়ী দেবীর চার পুত্রসন্তান ছিলেন। নাম ছিল রাজবিহারী দত্ত, নদীয়াবিহারী দত্ত, রসিকবিহারী দত্ত ও বিপিনবিহারী দত্ত। কিন্তু স্ত্রী ও তিন পুত্র অকালেই মারা যান, শুধু বেঁচে থাকেন বিপিনবিহারী দত্ত। মামার বাড়ি মৌলভীবাজারের ভুজবলে গিয়ে সেখানেই স্থায়ীভাবে থেকে যান বিপিনবিহারী। তিনিও অবশ্য রাধারমণের জীবদ্দশায়ই মারা যান। স্ত্রী ও তিন পুত্রসন্তানের প্রয়াণের পরে সংসারে জনশূন্যতা সৃষ্টি হওয়ার যন্ত্রণা তাকে সংসারজীবনের প্রতি উদাসীন করে তোলে।
রাধারমন নিজের মেধা ও দর্শনকে কাজে লাগিয়ে মানুষের মনে চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। তিনি একাধারে ছিলেন মরমি কবি, বৈষ্ণব সহজিয়া ঘরানার সাধক, ধামাইল গানের জনক কিংবা লোকায়ত বাংলার মহান কণ্ঠস্বর। জীবনের বড় একটা অংশ যিনি কাটিয়ে দিয়েছেন অনন্তের সন্ধানে, তেমনি প্রেম, বিরহ, বিচ্ছেদ, দেহতত্ত্ব, ভজন, ভক্তি, রাধাকৃষ্ণের আকুলতা নিয়ে বেঁধেছেন গান। নিজে কখনও সেসব গান না লিখলেও তার ভক্তরা শোনার সাথে সাথেই পুঁথিবদ্ধ করে ফেলতেন। এভাবে তিনি সৃষ্টি করে গেছেন তিন সহস্রাধিক গান, যা তাকে একজন কিংবদন্তি অমর গীতিকবি ও সুরসাধকের আসনে আসীন করেছে।
সুনামগঞ্জের আরেক মরমি কবি দেওয়ান হাসন রাজা ও রাধারমণ ছিলেন সমসাময়িক। তাদের মধ্যে চমৎকার সম্পর্কও ছিলো। তারা একে অপরকে চিঠিও লিখতেন। একবার হাসন রাজা রাধারমণের কুশল জানতে গানের চরণ বাঁধেন: ‘রাধারমণ তুমি কেমন, হাছন রাজা দেখতে চায়’। উত্তরে রাধারমণ লিখেন: ‘কুশল তুমি আছো কেমন- জানতে চায় রাধারমণ’। হাসন রাজা আর রাধারমণের মধ্যে মিল আছে আরও। দুজনেই প্রেম, বিরহ, বিচ্ছেদ, দেহতত্ত্ব আর সেই অনন্ত সত্ত্বাকে তালাশ করেছেন গানে, সাধনায়।
যদিও প্রমাণিতভাবে রাধারমণ দত্তের জন্মতারিখ খুঁজে পাওয়া যায়নি, তথাপি বিভিন্ন সূত্রমতে ২৬ মে হচ্ছে রাধারমণ দত্তের
জন্ম তারিখ। ২০২৩ ইং সালে ২৬ মে “জাতীয় ধামাইল দিবস” পালনের দাবী জানিয়ে সিলেটের হবিগঞ্জ জেলার সাংস্কৃতিক সংগঠন “ধামালি চুনারুঘাট” সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বরাবর স্মারকলিপি দিয়ে জাতীয় ধামাইল দিবস পালন শুরু করে । প্রতিবছরই সিলেটের বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি পর্যায় ”রাধারমন স্মরণ দিবস” ও “জাতীয় ধামাইল দিবস” পালন করে। এ উপলক্ষে সংগঠনটি নিরলস প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৪ ইং সালে ভারতের আসামের “সম্মিলিত লোকমঞ্চ, শিলচর” আন্তর্জাতিক ধামাইল দিবস পালন করে।
রাধারমণের অহিংসা, নিরহঙ্কার, নির্লোভ দর্শন এই সমাজ ও রাষ্ট্র চর্চা বৃদ্ধি , তার সৃষ্ট গানগুলোকে বৈশ্বিক আঙিনায় ছড়িয়ে দেয়া ও গবেষণা করার জন্য রাধারমণ দত্তের জন্মদিনটি “জাতীয় ধামাইল দিবস” ঘোষণা সহ এ ব্যাপারে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা খুবই জরুরি। তাই বাংলাদেশ সরকারের প্রতি সনির্বন্ধ অনুরোধ বাঙালি শুদ্ধ সংস্কৃতি লালন ও চর্চা বৃদ্ধি ও অপসংকৃতির হাত থেকে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে রক্ষাকল্পে “২৬ মে”-কে “জাতীয় ধামাইল দিবস” ঘোষণা করে শুদ্ধ সংস্কৃতির চর্চার পথ প্রসারিত করতে যেন মর্জি হয়। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছি।
রাধারমণ দত্তের মৃত্যুতারিখ ১০ই নভেম্বর তার জন্মভূমিতে উদযাপন হয়ে থাকে। এমন একজন গুণী সাধকের প্রয়াণ দিবস জাতীয়ভাবে কতটা উদযাপন হয়? ক’জন জানে তার অমর কীর্তিগুলোর কথা? রাধারমণের অহিংসা, নিরহঙ্কার, নির্লোভ দর্শন এই সমাজ, রাষ্ট্রে চর্চা করলে, তার সৃষ্ট গানগুলোকে বৈশ্বিক আঙিনায় ছড়িয়ে দিলেই কেবল তার প্রতি সঠিক শ্রদ্ধা জানানো হবে। রাধারমণ দত্তের গানের চর্চা বাড়াতে তার জন্মভিটায় রাধারমণ কমপ্লেক্স দ্রুত নির্মাণের দাবি রয়েছে স্থানীয় সাংস্কৃতিককর্মীদের।
সময়ের ব্যবধানে হারিয়ে যাচ্ছে ঔৎসুক্য শ্রোতা-দর্শকরাও। ধীরে ধীরে যেন হারিয়ে যাচ্ছে গানের সমৃদ্ধ ধারাগুলো। অতীতের সেই সুর কিংবা গান অতি দ্রুতই যেন পালটে যাচ্ছে। যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা লোকসংগীত শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতা করা হলে হয়তো এ সংগীতধারা সচল রাখা যেতে পারে বলে আমি মনে করি।
তথ্য সূত্র:
সিলেটের মরমী মানস সৈয়দ মোস্তফা কামাল, প্রবন্ধ রাধারমণ, পৃষ্ঠা ৯২, প্রকাশনায়- মহাকবি সৈয়দ সুলতান সাহিত্য ও গবেষণা পরিষদ, প্রকাশ কাল ২০০৯।
ঝাঁপ দিন:ক খ গ ঘ সিলেট বিভাগের ইতিবৃত্ত: নিবন্ধ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, মোহাম্মদ মুমিনুল হক, প্রকাশক সেন্টার ফর বাংলাদেশ রিচার্স ইউ কে, গ্রন্থ প্রকাশকাল: সেপ্টেম্বর ২০০১; পৃষ্ঠা ৪৯৯।
শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত পূর্বাংশ, দ্বিতীয় ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড, দ্বিতীয় অধ্যায়, জগন্নাথপুরের কথা, পৃষ্ঠা ৩৯৩, গ্রন্থকার – অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি; প্রকাশক: মোস্তফা সেলিম; উৎস প্রকাশন, ২০০৪।
“বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত রাধারমণ গীতিমালা”। ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৮ এপ্রিল ২০১২।]
*লেখক: সুহেল ইবনে ইসহাক (গীতিকবি ও কলাম লেখক)