১১:১৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৫

ব্রাশ ফায়ারে সেদিন ঝাঁজরা হয়েছিল বিয়ানীবাজারের ভূমিপুত্র বুদ্ধিজীবী জিসি দেব’র বুক!

স্টাফ রিপোর্টার:
  • আপডেট সময়ঃ ০৮:১৩:১৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ ২০২৫
  • / ১৭৪ বার পড়া হয়েছে।

রক্তস্নাত সেই ইতিহাসের পাতায় পাওয়া যায় সিলেটের বিয়ানীবাজারের ভূমিপুত্র গোবিন্দ চন্দ্র দেব ওরফে জিসি দেবের নাম। খ্যাতিমান এই ব্যক্তি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দার্শনিক বিভাগের অধ্যাপক। পেনসেলভেনিয়ার উইল্কস বেয়ার কলেজে শিক্ষকতা করার সময় তার দর্শন ভাবনা জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। জিসি দেবের মানবিক দর্শন প্রচারের লক্ষ্যে ‘দ্যা গোবিন্দা দেব ফাউন্ডেশন ফর ওয়ার্ল্ড ব্রাদারহুড’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে তিনি তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাড়িতে অবস্থান করছিলেন।

২৫ মার্চের সেই কালো রাতে পাক বাহিনী আর ক্ষুধার্ত হায়েনার মাঝে কোনো পার্থক্য ছিল না। গুলিবর্ষণ করে নির্বিচারে হত্যা করে যাচ্ছিল তারা। জিসি দেবের বাড়ির ওপর সারারাতই গুলি করতে থাকে একদল পাকসেনা। এখানে জিসি দেবের সাথে অবস্থান করছিলেন তার পালিত কন্যা ও কন্যার স্বামী। তাঁরা সবাই বুঝতে পারছিলেন, মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে। তবু মাথা ঠান্ডা রাখেন জিসি দেব। ভোরের দিকে মেয়েকে বলেন চা করতে। নিজে বসেন প্রার্থনায়। সে সময়ই দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ে পাক হানাদার বাহিনী।

একাত্তরে ধর্মকে অস্ত্রের মতো ব্যবহারের যে নজির দেখিয়েছে পাকিস্তানিরা, তার কোনো দ্বিতীয় উদাহরণ হয়তো পৃথিবীর ইতিহাসে নেই। জিসি দেব ছিলেন সনাতন ধর্মাবলম্বী। ‘কাঁহা মালাউন কাঁহা’ বলে চিৎকার করতে করতে তাকে হত্যা করতে আসে পাকিরা। পালিত মেয়ে রোকেয়া বেগমের স্বামী সামনে এগিয়ে এসে জিসি দেবকে বাঁচানোর জন্য পাকিস্তানিদের মন গলাতে কালেমা পড়েন। কিন্তু এতে তাদের মধ্যে কোনো ভাবান্তর হয় না। জিসি দেব দুই হাত উপরে তুলে ‘গুড সেন্স গুড সেন্স’ বলে তাদের থামানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু কিছুতেই কোনো কাজ হয়নি। পাকিস্তানি বাহিনী ব্রাশ ফায়ারে নির্মমভাবে হত্যা করে সদা হাস্যোজ্জ্বল জিসি দেব এবং তাঁর মেয়ের জামাইকে। তাঁর মেয়ে রোকেয়া বেগম ঘটনার আকস্মিকতায় জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যান বিধায় বেঁচে গিয়েছিলেন। ২৬ মার্চ বিকেলে জগন্নাথ হলের পশ্চিম পাশে জিসি দেবের মরদেহ মাটিচাপা দেয়া হয়।

গুণী এই বুদ্ধিজীবীর স্মরণে তাঁর নিজ গ্রামের বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার লাউতা গ্রামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। কিন্তু সংস্কারের অভাবে এর অবস্থা জরাজীর্ণ। তাঁর বাড়ির মালিকানা নিয়েও আছে নানান জটিলতা। আর এসবের পিছনে কারণ হলো বুদ্ধিজীবী দিবস ছাড়া এখানে তেমন কোনো পদচারণ থাকে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে উজ্জ্বীবিত রাখতে, শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের উদ্দেশ্যে এইসব স্মৃতিস্তম্ভের সংস্কার প্রয়োজন। শুধু নির্দিষ্ট দিবসে নয়, শহীদরা যেন শ্রদ্ধার্ঘ পান সারা বছরই।

উল্লেখ্য, অধ্যাপক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব ১৯০৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ ভারতের আসাম প্রদেশের পঞ্চখন্ড পরগনার (বর্তমানে সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলা) লাউতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি জি সি দেব নামেই বেশি পরিচিত। এছাড়া সম্বন্বয়ী দর্শনের জন্যও পরিচিত। জি সি দেবের পূর্বপুরুষ ছিলেন উচ্চগোত্রীয় ব্রাহ্মণ। তারা গুজরাট থেকে সিলেট এসেছিলেন। বাবার মৃত্যুর পর তিনি স্থানীয় মিশনারিদের তত্ত্বাবধানে বড় হন। শৈশবেই মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৯২৫ সালে বিয়ানীবাজার উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে এন্ট্রাস পরীক্ষায় ও কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ১৯২৭ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯২৯ সালে সংস্কৃত কলেজ থেকে ব্যাচেলর অব আর্টস ও ১৯৩১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন শাস্ত্রে মার্স্টাস সম্পন্ন করেন। জিসি দেব ১৯৪৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

জি সি দেব কলকাতা রিপন কলেজে শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে রিপন কলেজ দিনাজপুর স্থানান্তরিত হলে তিনিও চলে আসেন। যুদ্ধ শেষে কলকাতা না ফিরে সুরেন্দ্রনাথ কলেজের (দিনাজপুর) প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেব যোগদান করেন। ১৯৫৩ সালের জুলাইয়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ঢাকা হলের (বর্তমানে শহীদুল্লাহ হল) হাউস টিউটর হিসেবে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত দ্বায়িত্ব পালন করেন, একই বছর জগন্নাথ হলের প্রভোস্টের দ্বায়িত্ব পান। ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের চেয়্যারম্যানের দ্বায়িত্বভার গ্রহণ করেন ও ১৯৬৭ সালে প্রফেসর পদে পদোন্নতি লাভ করেন।

ড. দেব ১৯৬০ থেকে আমৃত্যু পাকিস্তান দর্শন সমিতির নির্বাচিত সম্পাদকের দ্বায়িত্ব পালন করে গেছেন। এছাড়া তার সমস্ত সম্পত্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েকে দান করে গেছেন। যা দ্বারা ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন কেন্দ্র (উঈচঝ) প্রতিষ্ঠিত হয়।

জি সি দেব এমএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্বর্ণপদক ও হেমচন্দ্র মুখার্জি রৌপ্যপদক লাভ করেন। আরও পান পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষিত সমাজের ‘দর্শন সাগর’ উপাধি (১৯৬১), একুশে পদক (১৯৮৫, মরণোত্তর) ও স্বাধীনতা পুরস্কার (২০০৮, মরণোত্তর)।

নিউজটি শেয়ার করুন
ট্যাগসঃ

বিস্তারিত লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষণ করুন

আপলোডকারীর তথ্য