গত বুধবার বিকেলে আমি আমার চেম্বারে রোগী দেখতেছিলাম । হঠাৎ আমাদের ডায়াগনস্টিক এর ২-৩ জন স্টাফ থেকে খবর এলো—একজন রোগী ৫মিনিট আগে হঠাৎই পড়ে গেছেন, নিস্তেজ হয়ে গেছেন। ছুটে গেলাম। দেখি ECG ফ্ল্যাট লাইন। Pulse নেই, Blood pressure নেই।
এক সেকেন্ড দেরি না করে CPR শুরু করি। বুকের ভেতরে চাপ দিই, শ্বাস দিই—ধীরে ধীরে রোগী কিছুটা রেসপন্স করলো। সাথে সাথেই স্টাফদের বললাম অ্যাম্বুলেন্স আনতে, কাছের একটি ক্লিনিকের ডাক্তার-নার্সদের রেডি থাকতে। Dr Rahman ভাই ও স্টাফদের সহায়তায় রোগীকে শিফট করা হলো । কিছুক্ষণ আমরা আশার আলো দেখেছিলাম, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই রোগীকে বাঁচানো গেল না।
বয়স মাত্র ৪০-৪৫(বাড়ি- ঘুংগাদিয়া, বিয়ানিবাজার)। একটি পরিবারের ভরসা, হয়তো কারো বাবা, কারো স্বামী, কারো সন্তান। অকালেই ঝরে গেলেন।
কিন্তু প্রশ্ন হলো—তিনি কেন মারা গেলেন?
কারণ তার প্রথম গন্তব্য ছিল বিয়ানিবাজার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। সেখানে chest pain নিয়ে তিনি গিয়েছিলেন। কিন্তু একটি সাধারণ ECG মেশিনও নেই। ফলে রোগীকে পায়ে হেঁটেই আমাদের ডায়াগনস্টিকে(CMS) আসতে হলো, আর সেখানে এসেই তিনি cardiac arrest-এ পড়ে যান। মাত্র দেড় থেকে দুই লাখ টাকার একটি ECG মেশিন! যদি সেটি থাকত—রোগীর হার্ট অ্যাটাক তখনই ধরা পড়তো, প্রাথমিক ওষুধ দেওয়া যেত, দ্রুত রেফার করা যেত।
তাহলে হয়তো আজ তিনি বেঁচে থাকতেন।
এটা শুধু এক রোগীর গল্প নয়।এরকম আরও অনেক সমস্যা আমাদের সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থায় বিদ্যমান—
NCD corner-এর ওষুধ(যেমন ডায়াবেটিস+ হাই প্রেসার+কোলেস্টেরল) বেশিরভাগ সময়েই পাওয়া যায় না, আর পেলেও অসম্পূর্ণ ডোজ।
উপজেলা হাসপাতালগুলোতে রেজিস্টার্ড ডাক্তার (MBBS)-এর সংখ্যাই চাহিদার তুলনায় মারাত্মক কম।একজন সাধারণ ডাক্তার চাইলেও রোগীকে সঠিক সময়ে সঠিক সেবা দিতে পারেন না, কারণ যন্ত্রপাতি আর সিস্টেম তাকে সহযোগিতা করে না।
এদিকে কিছু রাজনৈতিক নেতা (যেমন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সাহেব) ডাক্তারদের নিয়ে অবাঞ্ছিত মন্তব্য করেন—“ডাক্তাররা অযথা টেস্ট দেয়”। কিন্তু স্যার, আপনার আইনশৃঙ্খলার ক্ষেত্রেই তো ব্যর্থতা ভরপুর। আপনি জনগণকে নিরাপত্তা দিতে পারলেন না, বিচার ব্যবস্থা স্বচ্ছ করতে পারলেন না। জনসমর্থন পেতে ডাক্তারদের দোষারোপ করা সহজ, কিন্তু সরকারি উপজেলা হাসপাতালে ECG/Xray নেই, ওষুধ নেই, পর্যাপ্ত ডাক্তার নেই—এসব নিয়ে কোনোদিনও মুখ খোলেন না।
অন্যদিকে আমরা ডাক্তাররা দেশের যেকোন সঙ্কটকালীন মুহূর্তে স্বেচ্ছাসেবক হয়ে কাজ করি, রাত-দিন রোগীর সেবা দিই, সংকটে চিকিৎসা ফি ফ্রিতে করি, রোগীর পাশে থাকি। অথচ ব্যবসায়ী পণ্যদ্রব্যে ইচ্ছেমতো দাম বাড়ান, চালকরা ভাড়ায় বাড়তি নেন—এগুলো উনারা প্রশ্ন করে না।
আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেকদিন ধরে চেষ্টা করছি বিয়ানীবাজারে একটি Cardiac Centre গড়তে, যাতে হার্ট অ্যাটাকের রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে Mortality / মৃত্যুহার কমানো যায়। কিন্তু জায়গার অস্বাভাবিক দাম, চ্যারিটেবল ট্রাস্ট/প্রতিষ্ঠান এর অস্বাভাবিক ভাড়া দাবি ইত্যাদি কারণে সেটি করা এখনো সম্ভব হয়নি।
এইসব অভিজ্ঞতা আমাকে আবারও মনে করিয়ে দিল— সমস্যা ডাক্তার নয়, সমস্যাটা সিস্টেম। সিস্টেমকে বদলাতে না পারলে আরও অসংখ্য অকালমৃত্যু ঘটতেই থাকবে।
লেখক: ডাঃ শরীফ উদ্দিন।
সহকারী অধ্যাপক, কার্ডিওলজি বিভাগ, নর্থ ইষ্ট মেডিকেল কলেজ।
প্রধান সম্পাদকঃ আবুবকর সিদ্দিক সুমন। নির্বাহী সম্পাদকঃ রুবেল হাসনাইন। বার্তা সম্পাদকঃ রুমি বরুয়া।
গুলশান, ঢাকা-১২১৬, বাংলাদেশ। ইমেইলঃ admin@sylhet21.com,sylhet21.com@gmail.com মোবাইলঃ +1586 665 4225
©২০২৫ সিলেট ২১ সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত। | Developed Success Life IT