শৈশবের সেই খেলাগুলি আজ শুধুই স্মৃতি

- আপডেট সময়ঃ ০৫:৪২:৩২ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৬ মে ২০২৫
- / ৩১ বার পড়া হয়েছে।

ছন্দ তোলা বৃষ্টির খেলা, শৈশবে মোর দিচ্ছে দোলা—অনুভূতির পঞ্চমেলা, শীতের পিঠায় পুড়ছে খোলা।
কবি মাসুম পান্থের কবিতায় যেমন বর্ণিত, ঠিক তেমনই গ্রামীণ শৈশবের খেলাগুলোর ঝলক আজ শুধু স্মৃতির পাতায়। প্রযুক্তির কল্যাণে ফেসবুক, টিকটক, ইউটিউবের মোহে গা ভাসিয়ে দিয়েছে নতুন প্রজন্ম। অথচ তাদের অনেকেই জানেই না, বাঘ-ছাগল, ডাঙ্গল, গুটি খেলা, গাদি, লাটিম, কানামাছি ভোঁ ভোঁ, গোল্লাছুট, দাড়িয়াবান্ধা, লুকোচুরি, চোর-পুলিশ বা কুমির-ডাঙা—এ শব্দগুলো কোনো দিন বাঙালির শৈশবের অপরিহার্য অংশ ছিল।
এক সময় বিকালের মাঠ কেঁপে উঠত বাচ্চাদের উচ্ছ্বাসে। শীতের সকালে মাঠে কিংবা পুকুরঘাটে চলতো ‘দড়ি লাফ’ আর ‘ব্যাঙ লাফ’-এর প্রতিযোগিতা। গাছের ডাল দিয়ে তৈরি ‘খাজুর কাটা’ দিয়ে পাতা ফুটিয়ে বানানো হতো খেলনা। ‘লাটিম’ ঘোরাতে ঘোরাতে পাড়া কাঁপানো যে আনন্দ, তা বুঝতে হলে ঘরে বসে স্ক্রিনে নয়, মাঠে যেতে হতো।
লাটিমের সংঘর্ষে নিজের প্রিয় লাটিম ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাওয়া কিংবা কুলা ভরে মার্বেল খেলায় হার-জিতের উত্তেজনা, এসব এখন যেন কেবল কল্পনায় ভেসে ওঠে।
মেয়েদের অন্যতম জনপ্রিয় খেলা ছিল ‘কুতকুত’। স্কুল ছুটি শেষে দল বেঁধে মাঠে মাটিতে ঘর কেটে শুরু হতো লাফালাফি। এ খেলার নিয়ম, ধৈর্য ও সামঞ্জস্য চর্চার অপূর্ব অনুশীলন ছিল। অন্যদিকে, কৌশল আর বুদ্ধির খেলা ‘বউচি’তে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে ছুটে যাওয়ার সঙ্গে ছিল দলগত ঐক্য ও সাহসিকতার পরিচয়।
‘কানামাছি ভোঁ ভোঁ, যাকে পাবি তাকে ছোঁ’—এ গান যেন এখনো স্নিগ্ধ বিকালে কানে বাজে। চোখ বেঁধে দৌড়ানো, অন্যদের ধরার চেষ্টা—এ খেলায় ছিল নির্মল আনন্দ ও বন্ধুত্বের গভীরতা। ‘চোর-পুলিশ’ খেলায় টুকরো কাগজে লেখা চরিত্র নিয়ে গড়ে উঠতো ছোট্ট এক নাটকীয় জগৎ। কে হবে চোর, কে বাবু—নিয়েই চলতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা মজার খেলা।
‘লুকোচুরি’ খেলার সময় চোর গণনা করত, অন্যরা লুকিয়ে পড়ত। একে একে খুঁজে বের করা, আর মাঝে মাঝে ‘টিলোথ’ বলে ছুঁয়ে দিয়ে পাল্টে দেওয়া চোর—সব মিলিয়ে এটি ছিল এক রোমাঞ্চকর অভিযান।
‘ছোঁয়াছুঁয়ি’ ছিল সবচেয়ে সহজ অথচ প্রাণবন্ত খেলা। ‘বরফ-পানি’ ছিল তার রূপান্তরিত সংস্করণ, যেখানে ছুঁয়ে দিলে খেলোয়াড় বরফ হয়ে যেত, আর অন্য কেউ তাকে ছুঁয়ে আবার ‘পানি’ করে তুলত।
‘কুমির-ডাঙা’ খেলায় একদিকে ছিল ভয়ের আনন্দ, অন্যদিকে সাহসী দৌড়ঝাঁপ। ‘ডাঙা’ নিরাপদ এলাকা, আর ‘পানি’ ছিল কুমিরের রাজত্ব।
এসব খেলার মধ্য দিয়ে শিশুরা কেবল খেলতো না, তারা শিখত—বন্ধুত্ব, দলগত কাজ, কৌশল, আত্মরক্ষা, সাহস, আর সহানুভূতি। আজ সেসব খেলার মাঠে আগাছা, শিশুর হাতে মোবাইল।
স্থানীয় সচেতন মহল মনে করেন, এ ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলো আবার ফিরিয়ে আনা সময়ের দাবি। কারণ, এ খেলাগুলোর মাধ্যমে শিশুদের মনোজগতে যেমন সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটে, তেমনি শারীরিক সুস্থতা ও সামাজিক বন্ধনও মজবুত হয়।
শালিখার প্রবীণ শিক্ষক মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, আমরা যদি এ খেলাগুলো নতুন প্রজন্মের মাঝে ফেরাতে পারি, তবে তারা শুধু বিনোদনই পাবে না, পাবে শিকড়ের সঙ্গে এক গভীর সম্পর্কও।