০৫:১৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

সাদা পাথরে ‘কালো হাত’

ডেস্ক নিউজ:
  • আপডেট সময়ঃ ১১:৪১:৫০ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৭ মে ২০২৫
  • / ৭২ বার পড়া হয়েছে।

ঢল বা স্রোতের তোড়ে মেঘালয়ের পাহাড় থেকে নেমে আসা ছোট-বড় পাথর সিলেটের সীমান্তবর্তী ধলাই নদীর উৎসমুখে জমে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হওয়া ‘জল-নুড়ি-পাথরের’ অপূর্ব সুন্দর পর্যটনকেন্দ্র ‘সাদা পাথরে’ এখন থাবা বসাচ্ছে লোভীদের ‘কালো হাত’; যেখান থেকে ‘প্রশাসনের নাকের ডগায়’ দিনে-রাতে লুটে নেওয়া হচ্ছে শত শত কোটি টাকার খনিজ সম্পদ।

৫ অগাস্ট সরকার পরিবর্তনের পর আমূল বদলে গেছে পাহাড়-নদী আর সবুজে বেষ্টিত কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জের বালি, পাথর, নুড়িসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের লুটপাটের দখল-নিয়ন্ত্রণ।

প্রশাসন নামমাত্র অভিযান চালিয়ে লুটপাটের দায় এড়ানোর চেষ্টা করলেও স্থানীয়দের অভিযোগ, লুটেরাদের সঙ্গে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘অসৎ’ লোকজন জড়িত। আপত্তি-অভিযোগ জানিয়েও ফল হয়নি। ‘রাজনৈতিক ও প্রশাসনের সমন্বিত এই চক্র’ অনেক শক্তিশালী ও প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত বলে মনে করেন স্থানীয়রা।

গত দেড় যুগে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের ঘটনায় ভোলাগঞ্জ কোয়ারি, শাহ আরেফিন টিলা ও সংলগ্ন বাংকার এলাকায় অন্তত ৩৮ শ্রমিকের প্রাণ গেলেও লুটপাটকারীদের কাউকে কোনোদিন বিচারের মুখোমুখি হয়ে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হয়নি। বরং লুটপাটকে ‘থামাচাপা দেওয়ার প্রশাসনিক চেষ্টায়’ পরোক্ষে লুটপাটকারীদের হাতকেই শক্তিশালী করা হয়েছে বলেও অভিযোগ পরিবেশবাদীদের।

এ অবস্থা চলতে থাকলে শিগগির এ পর্যটনকেন্দ্র বিলীন হয়ে যাবে- এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপা সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম চৌধুরী কিম বলেন, “সাদা পাথর বলে তো আর এখানে কিছু থাকবে না। এখানে যে লুটপাট হচ্ছে, স্থানীয় প্রশাসন কোনোভাবেই এই লুটপাট বন্ধ করতে পারছে না। তারা ‘অথর্ব’ এবং এই অঞ্চল রক্ষায় ব্যর্থ।”

যদিও সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, “সাদা পাথর পর্যটনকেন্দ্র থেকে পাথর চুরি করছে, এ রকম কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। আশপাশের সংলগ্ন এলাকা থেকে তারা চুরি করার চেষ্টা করছে। আমরা অভিযানের মাধ্যমে এগুলো বন্ধ করছি। পর্যটনকেন্দ্র থেকে চুরির বিষয়টি দেখা হবে।”

 

কোথা থেকে আসে পাথর

ভোলাগঞ্জের সীমান্তবর্তী ধলাই নদীর উৎসমুখে এসে জমে ছোট-বড় পাথর। পানি যখন কমে যায় তখন নদীর তলদেশে পাথর পড়ে থাকে। সেই পাথরের উপর দিয়ে বয়ে যায় স্বচ্ছ জলের ধারা। পর্যটকরা এখানে এসে মূলত সেই ঝিরিঝিরি নদী, পাহাড় আর টিলার অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করেন। স্থানীয়ভাবে এখানে কিছু উদ্যোক্তাও তৈরি হয়েছে। সাদা সাদা পাথরের কারণে এলাকার নামই হয়ে গেছে ‘সাদা পাথর’।

সিলেট মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির উপাচার্য এবং ধরিত্রী রক্ষায় আমরা-ধরার সংগঠক অধ্যাপক মোহাম্মদ জহিরুল হক এখানকার বালি ও পাথর নিয়ে গবেষণা করেছেন।

তিনি বলেন, “সাদা পাথর পর্যটনকেন্দ্রের পাথরগুলো পাহাড়ি ঢলে আসা। বর্ষাকালে বেশি বৃষ্টি শুরু হলে মেঘালয়ের পাহাড়ি এলাকার ঢল নামে। তখন ঢলের পানির সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে বালু-পাথর আসে সীমান্ত নদীগুলোতে। এসব বালু-পাথর নদীর উৎস মুখে জমে থাকে। কয়েক বছর ধরে পাথর কোয়ারি বন্ধ থাকার কারণে ঢলে আসা পাথর জমেছে সাদা পাথর এলাকায়।”

সাদা পাথর এলাকার পরেই রয়েছে ‘বাংকার’ এলাকা। এটি মূলত রেলওয়ের অধিভুক্ত। এই বাংকার এলাকা থেকেই গত শতাব্দীর ষাটের দশকে ‘রোপওয়ে’ তৈরির মাধ্যমে ১৯ কিলোমিটার দূরের ছাতকে পাথর নিয়ে যেত রেলওয়ে। এখানে তাদের নানা স্থাপনাও ছিল। যেহেতু এক যুগ ধরে রেলওয়ে আর এখান থেকে পাথর উত্তোলন করে না। ফলে ৬০ একরের গোটা এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে পাথর তুলছে লুটপাটকারীরা।

এর পাশেই রয়েছে শাহ আরেফিন টিলা। খাস খতিয়ানে ১৩৭ দশমিক ৫০ একর জায়গায় এই টিলার অবস্থান। স্থানীয়দের ভাষ্য, এখানে ‘মতিয়া টিলা’ নামের আরেকটি টিলা ছিল। ২০০০ সালের দিকে এসব টিলায় ‘পাথর-খেকোদের’ প্রথম নজর পড়ে।

২০১৪ থেকে ২০১৫ সালের দিকে এখানে পাথর উত্তোলনে অবৈধ ‘বোমা মেশিনের’ ব্যবহার শুরু হয়। গত আড়াই দশকে পাথর ও মাটি সাবাড় করে নেওয়ায় টিলা দুটি এখন অনেকটা ‘কঙ্কাল’ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

পরিবেশবাদীদের অভিযোগ, সিলেট অঞ্চলের যাদুকাটা নদী, পিয়াইন নদী, জৈন্তাপুরের লালাখাল থেকে দীর্ঘদিন ধরেই অবৈধভাবে বালু-পাথর লুটে নেওয়া হচ্ছে। সবশেষ লোভীদের নজর পড়েছে এই সাদা পাথরে।

 

দখলদারির পরিবর্তন

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৫ অগাস্ট সরকারের পরিবর্তনের আগে এখানে পাথর লুটের সঙ্গে আওয়ামী লীগের লোকজন জড়িত ছিল। সরকার পরিবর্তনের পর এখানকার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তাদের প্রতিপক্ষরা। লুটপাট আগেও হয়েছে; তবে এখনকার লুটপাট আগের তুলনায় ‘অনেক বেশি’।

কারা এই চক্র চালায়, এমন প্রশ্ন স্থানীয় অনেককে জিজ্ঞাসা করেও সরাসরি কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। তারা বড় একটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সংশ্লিষ্টতার দিকে ইঙ্গিত করেন। ভয়ে কেউ মুখ খুলতে চান না।

এ অবস্থার মধ্যেই দেশের ৫১টি পাথর কোয়ারির মধ্যে ১৭টির ইজারা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ২৭ এপ্রিল বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সারা দেশের গেজেটভুক্ত পাথর, সিলিকা, বালু, নুড়িপাথর, সাদা মাটির কোয়ারিগুলোর ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

এর মধ্যে সিলেট জেলার ভোলাগঞ্জ, উৎমাছড়া, রতনপুর, বিছানাকান্দি ও লোভাছড়া পাথর মহালের ইজারা স্থগিত থাকবে। আর সংরক্ষিত বাংকার ও সাদা পাথর এলাকা কোয়ারিভুক্ত নয়।

 

রাতে তৎপরতা বেশি

গত সপ্তাহে সাদা পাথর ও বাংকার এলাকা গিয়ে দেখা গেছে, সংরক্ষিত বাংকারের পূর্ব-পশ্চিম ও দক্ষিণ দিক থেকে শত শত ইঞ্জিন ও হাতে চালিত বারকি নৌকা দিয়ে শ্রমিকরা পাথর তুলে নিচ্ছেন। কেউ নিচ্ছেন বালু, কেউবা পাথর। সবচেয়ে বেশি নৌকা রয়েছে বাংকারের পূর্ব ও দক্ষিণ দিকের অংশে।

বালু-পাথর উত্তোলন করতে গিয়ে ছোট-বড় গর্ত করে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে এলাকাটি। এলাকার গাছ ও পাকা ঘরবাড়ি কোনোটা হেলে, আবার কোনোটা ভেঙে পড়ছে। বালু-পাথর উত্তোলন করে বড় বড় গর্ত করার কারণে হেলে পড়ছে রোপওয়ের খুঁটিও। পূর্ব-উত্তর অংশের বড় পাথরগুলো আর নেই। কেউ টুকরি, কেউ বাঁশের ভার দিয়ে পাথর নিয়ে বাংকারের ভেতরে যাচ্ছেন।

কড়া নজরদারির মধ্যে চলছে এই লুটপাট। বাঁশ আর ত্রিপল দিয়ে বানানো হয়েছে অনেকগুলো ছাউনি। সেখানে বসেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন ‘সিন্ডিকেটের’ লোকেরা।

বাংকারের উত্তর দিকেই সাদা পাথর এলাকা। সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, অনেক স্থানেই ছোট-বড় পাথরের কোনো অস্তিত্ব এখন আর নেই। শুধু বালু পড়ে আছে।

সাদা পাথর যাওয়ার পথে বাংকারের পশ্চিম পাড়ের বিভিন্ন স্থানে বারকি নৌকাতে বড়-ছোট পাথর বোঝাই করেতে শ্রমিদের ব্যস্ততা দেখা গেছে। কোথাও কোথাও ৫০ থেকে ১০০টি বারকি নৌকায় বোঝাই করা হচ্ছে পাথর।

বড় পাথর মাথায় করে এনে নদীর পাড়ে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। আর নিচে থাকা শ্রমিকেরা সেই পাথর ধরে নৌকাতে ওঠাচ্ছেন। ভুতু ও সিঙ্গেল পাথর (ছোট পাথর) টুকরিতে করে এনে নৌকায় ফেলছেন শ্রমিকেরা। কে কার আগে নৌকা বোঝাই করবে, এ নিয়ে চলছে প্রতিযোগিতা।

সাদা পাথর পর্যটনকেন্দ্রে থাকা দোকানিরা জানান, দিনের বেলা একদল লোক পাথর সরিয়ে নিয়ে যায় বাংকারের ভেতরে। পরে সেই পাথর বাংকারের পশ্চিম দিকে এনে বারকি নৌকা দিয়ে পরিবহন করা হয়। তবে দিনের চেয়ে রাতের বেলা সাদা পাথর এলাকা থেকে বেশি পাথর সরানো হয়। কারণ রাতের অন্ধকারে লুটপাটকারীদের দেখার কেউ নেই।

আর দিনের বেলা কেউ তাদের বিরুদ্ধে গেলে মারধর করা হয়। প্রশাসন অভিযান করতে গেলে তাদের দিকে পাথর ছুড়ে মারা হয়। লুট করা পাথর ট্রাকে করে চলে যায় আধা কিলোমিটার দূরের ক্র্যাশার মিলগুলোতে। সিলেটের সীমান্তবর্তী এলাকায় অন্তত দেড় হাজার ক্র্যাশার মেশিন আছে। এর মধ্যে ভোলাগঞ্জ ও ধুপাগুল এলাকাতেই রয়েছে পাঁচ শতাধিক।

অপরদিকে বাংকার এলাকার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা রেলওয়ের এক সদস্য জানান, বিভিন্ন স্থানে ৩০ থেকে ৫০ ফুট গর্ত করে পাথর ওঠানো হয়। পুরো এলাকা ক্ষত-বিক্ষত করা হয়েছে। গর্ত করার কারণে সরকারি স্থাপনাগুলো ভেঙে পড়েছে।

“গর্তে পানি জমে গেলে লিস্টার মেশিন দিয়ে পানি সেচে পাথর উত্তোলন করেন শ্রমিকেরা। গর্তে চাপা পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। একজন মারাও গেছে। তারপরও শ্রমিকেরা এই কাজ করছে।”

সম্প্রতি সাদা পাথর এলাকা ঘুরে আসা সিলেট নগরীর বাসিন্দা আফজাল হোসেন বলেন, “পর্যটনকেন্দ্রের মূল স্পটের একপাশের বড় বড় পাথরগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে মূল স্পটের একপাশে বড় পাথরগুলো রয়েছে। এই সুন্দর পর্যটনকেন্দ্রটি শেষ করে দেওয়া হচ্ছে।

“আপনি গেলে দেখতে পাবেন মূল স্পটের বাঁ পাশের বড় বড় পাথর নেই। বাঁ পাশের কোথাও কোথাও বালুচর জেগে ওঠেছে। বাঁ পাশ থেকে শুধু বড় পাথরই সরানো হয়নি, ছোট-ছোট পাথরও নিয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রকাশ্যে দিনের বেলা পাথর নিয়ে যাচ্ছে। প্রশাসন বসে বসে সে দৃশ্য দেখছে। এই হচ্ছে অবস্থা।”

 

দর-দাম ও চাঁদাবাজি

বালু-পাথর শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একটি বারকি নৌকাতে কম হলেও দুজন শ্রমিক লাগে। একটি নৌকার ৩০ থেকে ৪০ ফুট বালু ধরে। প্রতিফুট ২০ থেকে ২৫ টাকা করে ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন শ্রমিকেরা।

ব্যবসায়ীরা সেই বালু নিজের সাইটে নিয়ে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা ফুট বিক্রি করেন। পাথর বোঝাই প্রতি বারকি নৌকা বিক্রি করা হয় চার হাজার থেকে ছয় হাজার টাকায়।

পরে ব্যবসায়ীরা সেই পাথর মিলে ভেঙে বিক্রি করেন দেড়শ টাকা ঘনফুট দরে। একটি বারকি নৌকায় ৩০ থেকে ৪০ ঘনফুট পাথর ধরে। প্রতিদিন বালু-পাথর মিলিয়ে একটি নৌকা চারবার পরিবহন করতে পারেন শ্রমিকরা।

এ ছাড়া ‘সেইভ মেশিন’ বসিয়েও নদী থেকে পাথর উত্তোলন করা হয়ে থাকে।

কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা অ্যাডভোকেট ফরহাদ খন্দকার বলেন, “একটি মেশিন থেকে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা চাঁদা তোলা হয়। দয়ারবাজার এলাকায় বালুমহল থেকে প্রতিটি ট্রাক থেকে দেড় হাজার টাকা চাঁদা তোলা হয়।”

প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলের নাম ভাঙিয়ে এই চাঁদাবাজি করা হয় বলে অভিযোগ করেন আইনজীবী ফরহাদ খন্দকার।

তবে এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ।

এ ব্যাপারে জানতে কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি উজায়ের আল মাহমুদ আদনানকে মোবাইলে ফোন করলেও তিনি ধরেননি।

 

পাথরে চাপা শত প্রাণ

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি-বেলার হিসেবে, ২০০৫ সাল থেকে ২০২৫ সালের ১২ পর্যন্ত সিলেট জেলার চার উপজেলার পাথর কোয়ারিতে ভূমিধসে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

 

রেলের ক্ষতি ৪০০ কোটি টাকা

রেলওয়ের সিলেটের জ্যেষ্ঠ সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ মোহাম্মদ আজমাইন মাহতাব বলছিলেন, ভোলাগঞ্জের বাংকার এলাকায় রেলওয়ের ৫৯ একর জমি আছে। জমিটির পুরো এলাকায় পাথর আর বালুতে ভর্তি ছিল।

ওই জামি থেকে বালু-পাথর লুটপাটের কারণে রোপওয়ের ১০০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি ও স্থাপনার ক্ষতি হয়েছে। আর জামিতে থাকা ৩০০ কোটি টাকার বালু-পাথর লুটপাট করা হয়েছে। এ বিষয়ে অভিযোগপত্রও দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

প্রকৌশলী সৈয়দ মোহাম্মদ আজমাইন মাহতাব বলেন, “৫ অগাস্ট রাতে দুই শতাধিক নৌকা নিয়ে হামলা চালিয়ে লুটপাট করা হয়। বাংকার এলাকায় বড় বড় গর্ত করে পাথর উত্তোলনের ফলে ধসে পড়েছে বেশ কিছু ভবন। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে পুলিশের ব্যারাক, বিদ্যালয়ের ভবন, গুদাম, ছয়টি ব্যারাক ভবন, বাসভবন, রেস্ট হাউস, রোপওয়ের পাওয়ার হাউসের দরজা-জানালা, ছাদের টিন, লোহার অ্যাঙ্গেল থেকে শুরু করে বহনযোগ্য সব কিছু নিয়ে গেছে।”

রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, ভোলাগঞ্জ থেকে ছাতক পর্যন্ত ১৯ দশমিক ২০ কিলোমিটার রোপওয়ের নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৯৬৪ সালে। ব্রিটিশ রোপওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি এটি নির্মাণ করেছিল।

১৯৭০ সালে নির্মাণকাজ শেষ হলে জলযানের বিকল্প হিসেবে ১১৯টি খুঁটির মাধ্যমে শুরু হয় পাথর পরিবহন। এই রোপওয়ের বার্ষিক পাথর পরিবহন সক্ষমতা ১২ লাখ ঘনফুট।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় রোপওয়েটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে মেরামত করে ১৯৮০ সালে ফের এটি চালু করা হয়। সচল ছিল ২০১৩ সাল পর্যন্ত। ওই বছরের ৩১ ডিসেম্বর শেষবার এটি পাথর পরিবহন করে।

 

ঝুঁকিতে ধলাই সেতু

কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার উত্তর রনিখাই ও পূর্ব ইসলামপুরকে এক সঙ্গে যুক্ত করতে ২০০৩ সালে ১২ কোটি ৩১ লাখ ৫০ হাজার টাকা খরচ করে নির্মাণ করা হয় ধলাই সেতু। সেতুর গোড়া থেকে অবাধে বালু উত্তোলনের ফলে সেটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। অনেক স্থানে পিলার থেকে মাটি সরে গেছে।

সম্প্রতি সেখানে গিয়ে দেখা যায়, সেতুর গোড়া থেকে বালু উত্তোলন করে বারকি নৌকায় বোঝাই করা হচ্ছে। পিলারের গোড়া থেকে মাটি সরে বড় গর্ত তৈরি হয়েছে।

৪৩৪ দশমিক ৩৫ মিটার দীর্ঘ ও ৯ দশমিক ৫ মিটার প্রস্থের সেতুটি ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরে চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। সেতুর স্থায়িত্ব ধরা হয় ৭৫ বছর। এই সেতু দিয়ে অর্ধ লাখ মানুষ সরাসরি সড়ক যোগাযোগের আওতায় আসে।

পাশাপাশি দেশের সর্ববৃহৎ ভোলাগঞ্জ কোয়ারি থেকে পাথর পরিবহন সহজতর হয়। এ ছাড়া এই সেতু দিয়ে গোয়াইনঘাট উপজেলার সঙ্গেও যাতায়াত সহজ হয়।

সেতুর নিচ থেকে বালু উত্তোলনের ঘটনায় ১২ মার্চ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ধলাই নদের পূর্ব পারের বাসিন্দা মো. ফয়জুর রহমান জেলা প্রশাসক বরাবর একটি স্মারকলিপি দেন।

তবে তাতে কোনো কাজ হয়নি বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ফয়জুর। তিনি বলেন, “দেখা গেছে, এসিল্যান্ড অভিযানে আসার আগে বালুখোকোরা খবর পেয়ে যায়। প্রশাসনের লোকেরাই বলে দেয়, তারা আসতেছে। এরকম রের্কডও আমার কাছে আছে।”

সড়ক ও জনপথ-সওজ সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী আমির হোসেন বলেন, “ধলাই সেতুর গোড়া থেকে বালু উত্তোলনের বিষয়টি শুনেছি। সেতুটির অবস্থা দেখতে কর্মকর্তা যাবেন। উনি দেখে আসার পর বলা যাবে সেতুটির প্রকৃত অবস্থা কী।”

এ ব্যাপারে সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বলেন, “ব্রিজের পাশে প্রশাসন নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। ব্রিজ রক্ষার বিষয়ে সড়ক বিভাগকে জানানো হয়েছে। তারাও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।”

 

প্রশাসনের প্রতি ক্ষোভ

অবাধে বালু-পাথর লুটপাট হলেও প্রশাসন কোনো ভূমিকা নিতে পারছে না বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বাপার সিলেট জেলার সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম চৌধুরী কিম।

তিনি বলেন, “দুই কারণে এটা হতে পারে। একটা হচ্ছে, এখানকার সম্পদের অনেক মূল্য। এই টাকার অংশ সরকারের লোকজনের কাছে যায়। আর তারা যদি টাকা না নিয়ে থাকেন, তাহলে তারা এমন কোনো শক্তি আছে যাদের কাছে তারা পরাজিত। উনারা তাদের নাম প্রকাশ করতে পারছেন না।

“তাহলে এই লুটপাট কারা করছে? উনারা (প্রশাসনের লোকজন) বলেন যে, রাজনৈতিক দল বা এই চাঁদাবাজ গোষ্ঠী এই লুটেরা গোষ্ঠী এটা করছে, আমরা তাদেরকে প্রতিহত করতে পারছি না।”

কিম বলেন, “এই লুটপাট নিয়ে সিলেট জেলা প্রশাসকের কাছে অসংখ্য মিডিয়া থেকে প্রশ্ন করা হচ্ছে। আমিও নিজে তার কাছে ব্যক্তিগতভাবে অসংখ্য জায়গায় অনেক লুটপাটের বিষয়, পরিবেশ ধ্বংসের নানান তথ্য পাঠাচ্ছি। কিন্তু পদক্ষেপ তো খুবই গৌণ। এমনকি লুটপাট বন্ধ করতে হলে তো আলোচনা করতে হবে, সে পদক্ষেপ নিতে হবে। উনারা সেই কথাগুলো কোনোভাবেই জানাচ্ছেন না।”

এ ব্যাপারে জানতে ৭ মে বিকালে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আজিজুন্নাহারের কার্যালয়ে গেলে তিনি এই প্রতিবেদককে প্রশ্ন করেন, “কাকে জানিয়ে এখানে এসেছেন?”

কার কাছে জানাতে হবে প্রশ্ন করলে ইউএনও বলেন, “না, আপনারা আসতেই পারেন।”

তবে তিনি বালু-পাথর লুটপাট নিয়ে ক্যামেরা বা অডিও রেকর্ডারের সামনে কথা বলতে রাজি হননি।

আজিজুন্নাহার বলছিলেন, “আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। গত কয়েকদিন আগে বাংকার এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে নয়জনকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।”

তবে এখান থেকে কী পরিমাণ পাথর লুটপাট হয়েছে তার কোনো তথ্য নেই বলে জানান ইউএনও।

সিলেট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদও বলেন, “আমরা পরিমাপ করতে পারি নাই। বিএমডির সঙ্গে কথা বলেতে হবে।”

নিউজটি শেয়ার করুন
ট্যাগসঃ

বিস্তারিত লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষণ করুন

আপলোডকারীর তথ্য

সাদা পাথরে ‘কালো হাত’

আপডেট সময়ঃ ১১:৪১:৫০ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৭ মে ২০২৫

ঢল বা স্রোতের তোড়ে মেঘালয়ের পাহাড় থেকে নেমে আসা ছোট-বড় পাথর সিলেটের সীমান্তবর্তী ধলাই নদীর উৎসমুখে জমে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হওয়া ‘জল-নুড়ি-পাথরের’ অপূর্ব সুন্দর পর্যটনকেন্দ্র ‘সাদা পাথরে’ এখন থাবা বসাচ্ছে লোভীদের ‘কালো হাত’; যেখান থেকে ‘প্রশাসনের নাকের ডগায়’ দিনে-রাতে লুটে নেওয়া হচ্ছে শত শত কোটি টাকার খনিজ সম্পদ।

৫ অগাস্ট সরকার পরিবর্তনের পর আমূল বদলে গেছে পাহাড়-নদী আর সবুজে বেষ্টিত কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জের বালি, পাথর, নুড়িসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের লুটপাটের দখল-নিয়ন্ত্রণ।

প্রশাসন নামমাত্র অভিযান চালিয়ে লুটপাটের দায় এড়ানোর চেষ্টা করলেও স্থানীয়দের অভিযোগ, লুটেরাদের সঙ্গে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘অসৎ’ লোকজন জড়িত। আপত্তি-অভিযোগ জানিয়েও ফল হয়নি। ‘রাজনৈতিক ও প্রশাসনের সমন্বিত এই চক্র’ অনেক শক্তিশালী ও প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত বলে মনে করেন স্থানীয়রা।

গত দেড় যুগে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের ঘটনায় ভোলাগঞ্জ কোয়ারি, শাহ আরেফিন টিলা ও সংলগ্ন বাংকার এলাকায় অন্তত ৩৮ শ্রমিকের প্রাণ গেলেও লুটপাটকারীদের কাউকে কোনোদিন বিচারের মুখোমুখি হয়ে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হয়নি। বরং লুটপাটকে ‘থামাচাপা দেওয়ার প্রশাসনিক চেষ্টায়’ পরোক্ষে লুটপাটকারীদের হাতকেই শক্তিশালী করা হয়েছে বলেও অভিযোগ পরিবেশবাদীদের।

এ অবস্থা চলতে থাকলে শিগগির এ পর্যটনকেন্দ্র বিলীন হয়ে যাবে- এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপা সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম চৌধুরী কিম বলেন, “সাদা পাথর বলে তো আর এখানে কিছু থাকবে না। এখানে যে লুটপাট হচ্ছে, স্থানীয় প্রশাসন কোনোভাবেই এই লুটপাট বন্ধ করতে পারছে না। তারা ‘অথর্ব’ এবং এই অঞ্চল রক্ষায় ব্যর্থ।”

যদিও সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, “সাদা পাথর পর্যটনকেন্দ্র থেকে পাথর চুরি করছে, এ রকম কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। আশপাশের সংলগ্ন এলাকা থেকে তারা চুরি করার চেষ্টা করছে। আমরা অভিযানের মাধ্যমে এগুলো বন্ধ করছি। পর্যটনকেন্দ্র থেকে চুরির বিষয়টি দেখা হবে।”

 

কোথা থেকে আসে পাথর

ভোলাগঞ্জের সীমান্তবর্তী ধলাই নদীর উৎসমুখে এসে জমে ছোট-বড় পাথর। পানি যখন কমে যায় তখন নদীর তলদেশে পাথর পড়ে থাকে। সেই পাথরের উপর দিয়ে বয়ে যায় স্বচ্ছ জলের ধারা। পর্যটকরা এখানে এসে মূলত সেই ঝিরিঝিরি নদী, পাহাড় আর টিলার অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করেন। স্থানীয়ভাবে এখানে কিছু উদ্যোক্তাও তৈরি হয়েছে। সাদা সাদা পাথরের কারণে এলাকার নামই হয়ে গেছে ‘সাদা পাথর’।

সিলেট মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির উপাচার্য এবং ধরিত্রী রক্ষায় আমরা-ধরার সংগঠক অধ্যাপক মোহাম্মদ জহিরুল হক এখানকার বালি ও পাথর নিয়ে গবেষণা করেছেন।

তিনি বলেন, “সাদা পাথর পর্যটনকেন্দ্রের পাথরগুলো পাহাড়ি ঢলে আসা। বর্ষাকালে বেশি বৃষ্টি শুরু হলে মেঘালয়ের পাহাড়ি এলাকার ঢল নামে। তখন ঢলের পানির সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে বালু-পাথর আসে সীমান্ত নদীগুলোতে। এসব বালু-পাথর নদীর উৎস মুখে জমে থাকে। কয়েক বছর ধরে পাথর কোয়ারি বন্ধ থাকার কারণে ঢলে আসা পাথর জমেছে সাদা পাথর এলাকায়।”

সাদা পাথর এলাকার পরেই রয়েছে ‘বাংকার’ এলাকা। এটি মূলত রেলওয়ের অধিভুক্ত। এই বাংকার এলাকা থেকেই গত শতাব্দীর ষাটের দশকে ‘রোপওয়ে’ তৈরির মাধ্যমে ১৯ কিলোমিটার দূরের ছাতকে পাথর নিয়ে যেত রেলওয়ে। এখানে তাদের নানা স্থাপনাও ছিল। যেহেতু এক যুগ ধরে রেলওয়ে আর এখান থেকে পাথর উত্তোলন করে না। ফলে ৬০ একরের গোটা এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে পাথর তুলছে লুটপাটকারীরা।

এর পাশেই রয়েছে শাহ আরেফিন টিলা। খাস খতিয়ানে ১৩৭ দশমিক ৫০ একর জায়গায় এই টিলার অবস্থান। স্থানীয়দের ভাষ্য, এখানে ‘মতিয়া টিলা’ নামের আরেকটি টিলা ছিল। ২০০০ সালের দিকে এসব টিলায় ‘পাথর-খেকোদের’ প্রথম নজর পড়ে।

২০১৪ থেকে ২০১৫ সালের দিকে এখানে পাথর উত্তোলনে অবৈধ ‘বোমা মেশিনের’ ব্যবহার শুরু হয়। গত আড়াই দশকে পাথর ও মাটি সাবাড় করে নেওয়ায় টিলা দুটি এখন অনেকটা ‘কঙ্কাল’ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

পরিবেশবাদীদের অভিযোগ, সিলেট অঞ্চলের যাদুকাটা নদী, পিয়াইন নদী, জৈন্তাপুরের লালাখাল থেকে দীর্ঘদিন ধরেই অবৈধভাবে বালু-পাথর লুটে নেওয়া হচ্ছে। সবশেষ লোভীদের নজর পড়েছে এই সাদা পাথরে।

 

দখলদারির পরিবর্তন

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৫ অগাস্ট সরকারের পরিবর্তনের আগে এখানে পাথর লুটের সঙ্গে আওয়ামী লীগের লোকজন জড়িত ছিল। সরকার পরিবর্তনের পর এখানকার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তাদের প্রতিপক্ষরা। লুটপাট আগেও হয়েছে; তবে এখনকার লুটপাট আগের তুলনায় ‘অনেক বেশি’।

কারা এই চক্র চালায়, এমন প্রশ্ন স্থানীয় অনেককে জিজ্ঞাসা করেও সরাসরি কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। তারা বড় একটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সংশ্লিষ্টতার দিকে ইঙ্গিত করেন। ভয়ে কেউ মুখ খুলতে চান না।

এ অবস্থার মধ্যেই দেশের ৫১টি পাথর কোয়ারির মধ্যে ১৭টির ইজারা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ২৭ এপ্রিল বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সারা দেশের গেজেটভুক্ত পাথর, সিলিকা, বালু, নুড়িপাথর, সাদা মাটির কোয়ারিগুলোর ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

এর মধ্যে সিলেট জেলার ভোলাগঞ্জ, উৎমাছড়া, রতনপুর, বিছানাকান্দি ও লোভাছড়া পাথর মহালের ইজারা স্থগিত থাকবে। আর সংরক্ষিত বাংকার ও সাদা পাথর এলাকা কোয়ারিভুক্ত নয়।

 

রাতে তৎপরতা বেশি

গত সপ্তাহে সাদা পাথর ও বাংকার এলাকা গিয়ে দেখা গেছে, সংরক্ষিত বাংকারের পূর্ব-পশ্চিম ও দক্ষিণ দিক থেকে শত শত ইঞ্জিন ও হাতে চালিত বারকি নৌকা দিয়ে শ্রমিকরা পাথর তুলে নিচ্ছেন। কেউ নিচ্ছেন বালু, কেউবা পাথর। সবচেয়ে বেশি নৌকা রয়েছে বাংকারের পূর্ব ও দক্ষিণ দিকের অংশে।

বালু-পাথর উত্তোলন করতে গিয়ে ছোট-বড় গর্ত করে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে এলাকাটি। এলাকার গাছ ও পাকা ঘরবাড়ি কোনোটা হেলে, আবার কোনোটা ভেঙে পড়ছে। বালু-পাথর উত্তোলন করে বড় বড় গর্ত করার কারণে হেলে পড়ছে রোপওয়ের খুঁটিও। পূর্ব-উত্তর অংশের বড় পাথরগুলো আর নেই। কেউ টুকরি, কেউ বাঁশের ভার দিয়ে পাথর নিয়ে বাংকারের ভেতরে যাচ্ছেন।

কড়া নজরদারির মধ্যে চলছে এই লুটপাট। বাঁশ আর ত্রিপল দিয়ে বানানো হয়েছে অনেকগুলো ছাউনি। সেখানে বসেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন ‘সিন্ডিকেটের’ লোকেরা।

বাংকারের উত্তর দিকেই সাদা পাথর এলাকা। সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, অনেক স্থানেই ছোট-বড় পাথরের কোনো অস্তিত্ব এখন আর নেই। শুধু বালু পড়ে আছে।

সাদা পাথর যাওয়ার পথে বাংকারের পশ্চিম পাড়ের বিভিন্ন স্থানে বারকি নৌকাতে বড়-ছোট পাথর বোঝাই করেতে শ্রমিদের ব্যস্ততা দেখা গেছে। কোথাও কোথাও ৫০ থেকে ১০০টি বারকি নৌকায় বোঝাই করা হচ্ছে পাথর।

বড় পাথর মাথায় করে এনে নদীর পাড়ে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। আর নিচে থাকা শ্রমিকেরা সেই পাথর ধরে নৌকাতে ওঠাচ্ছেন। ভুতু ও সিঙ্গেল পাথর (ছোট পাথর) টুকরিতে করে এনে নৌকায় ফেলছেন শ্রমিকেরা। কে কার আগে নৌকা বোঝাই করবে, এ নিয়ে চলছে প্রতিযোগিতা।

সাদা পাথর পর্যটনকেন্দ্রে থাকা দোকানিরা জানান, দিনের বেলা একদল লোক পাথর সরিয়ে নিয়ে যায় বাংকারের ভেতরে। পরে সেই পাথর বাংকারের পশ্চিম দিকে এনে বারকি নৌকা দিয়ে পরিবহন করা হয়। তবে দিনের চেয়ে রাতের বেলা সাদা পাথর এলাকা থেকে বেশি পাথর সরানো হয়। কারণ রাতের অন্ধকারে লুটপাটকারীদের দেখার কেউ নেই।

আর দিনের বেলা কেউ তাদের বিরুদ্ধে গেলে মারধর করা হয়। প্রশাসন অভিযান করতে গেলে তাদের দিকে পাথর ছুড়ে মারা হয়। লুট করা পাথর ট্রাকে করে চলে যায় আধা কিলোমিটার দূরের ক্র্যাশার মিলগুলোতে। সিলেটের সীমান্তবর্তী এলাকায় অন্তত দেড় হাজার ক্র্যাশার মেশিন আছে। এর মধ্যে ভোলাগঞ্জ ও ধুপাগুল এলাকাতেই রয়েছে পাঁচ শতাধিক।

অপরদিকে বাংকার এলাকার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা রেলওয়ের এক সদস্য জানান, বিভিন্ন স্থানে ৩০ থেকে ৫০ ফুট গর্ত করে পাথর ওঠানো হয়। পুরো এলাকা ক্ষত-বিক্ষত করা হয়েছে। গর্ত করার কারণে সরকারি স্থাপনাগুলো ভেঙে পড়েছে।

“গর্তে পানি জমে গেলে লিস্টার মেশিন দিয়ে পানি সেচে পাথর উত্তোলন করেন শ্রমিকেরা। গর্তে চাপা পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। একজন মারাও গেছে। তারপরও শ্রমিকেরা এই কাজ করছে।”

সম্প্রতি সাদা পাথর এলাকা ঘুরে আসা সিলেট নগরীর বাসিন্দা আফজাল হোসেন বলেন, “পর্যটনকেন্দ্রের মূল স্পটের একপাশের বড় বড় পাথরগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে মূল স্পটের একপাশে বড় পাথরগুলো রয়েছে। এই সুন্দর পর্যটনকেন্দ্রটি শেষ করে দেওয়া হচ্ছে।

“আপনি গেলে দেখতে পাবেন মূল স্পটের বাঁ পাশের বড় বড় পাথর নেই। বাঁ পাশের কোথাও কোথাও বালুচর জেগে ওঠেছে। বাঁ পাশ থেকে শুধু বড় পাথরই সরানো হয়নি, ছোট-ছোট পাথরও নিয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রকাশ্যে দিনের বেলা পাথর নিয়ে যাচ্ছে। প্রশাসন বসে বসে সে দৃশ্য দেখছে। এই হচ্ছে অবস্থা।”

 

দর-দাম ও চাঁদাবাজি

বালু-পাথর শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একটি বারকি নৌকাতে কম হলেও দুজন শ্রমিক লাগে। একটি নৌকার ৩০ থেকে ৪০ ফুট বালু ধরে। প্রতিফুট ২০ থেকে ২৫ টাকা করে ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন শ্রমিকেরা।

ব্যবসায়ীরা সেই বালু নিজের সাইটে নিয়ে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা ফুট বিক্রি করেন। পাথর বোঝাই প্রতি বারকি নৌকা বিক্রি করা হয় চার হাজার থেকে ছয় হাজার টাকায়।

পরে ব্যবসায়ীরা সেই পাথর মিলে ভেঙে বিক্রি করেন দেড়শ টাকা ঘনফুট দরে। একটি বারকি নৌকায় ৩০ থেকে ৪০ ঘনফুট পাথর ধরে। প্রতিদিন বালু-পাথর মিলিয়ে একটি নৌকা চারবার পরিবহন করতে পারেন শ্রমিকরা।

এ ছাড়া ‘সেইভ মেশিন’ বসিয়েও নদী থেকে পাথর উত্তোলন করা হয়ে থাকে।

কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা অ্যাডভোকেট ফরহাদ খন্দকার বলেন, “একটি মেশিন থেকে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা চাঁদা তোলা হয়। দয়ারবাজার এলাকায় বালুমহল থেকে প্রতিটি ট্রাক থেকে দেড় হাজার টাকা চাঁদা তোলা হয়।”

প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলের নাম ভাঙিয়ে এই চাঁদাবাজি করা হয় বলে অভিযোগ করেন আইনজীবী ফরহাদ খন্দকার।

তবে এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ।

এ ব্যাপারে জানতে কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি উজায়ের আল মাহমুদ আদনানকে মোবাইলে ফোন করলেও তিনি ধরেননি।

 

পাথরে চাপা শত প্রাণ

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি-বেলার হিসেবে, ২০০৫ সাল থেকে ২০২৫ সালের ১২ পর্যন্ত সিলেট জেলার চার উপজেলার পাথর কোয়ারিতে ভূমিধসে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

 

রেলের ক্ষতি ৪০০ কোটি টাকা

রেলওয়ের সিলেটের জ্যেষ্ঠ সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ মোহাম্মদ আজমাইন মাহতাব বলছিলেন, ভোলাগঞ্জের বাংকার এলাকায় রেলওয়ের ৫৯ একর জমি আছে। জমিটির পুরো এলাকায় পাথর আর বালুতে ভর্তি ছিল।

ওই জামি থেকে বালু-পাথর লুটপাটের কারণে রোপওয়ের ১০০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি ও স্থাপনার ক্ষতি হয়েছে। আর জামিতে থাকা ৩০০ কোটি টাকার বালু-পাথর লুটপাট করা হয়েছে। এ বিষয়ে অভিযোগপত্রও দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

প্রকৌশলী সৈয়দ মোহাম্মদ আজমাইন মাহতাব বলেন, “৫ অগাস্ট রাতে দুই শতাধিক নৌকা নিয়ে হামলা চালিয়ে লুটপাট করা হয়। বাংকার এলাকায় বড় বড় গর্ত করে পাথর উত্তোলনের ফলে ধসে পড়েছে বেশ কিছু ভবন। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে পুলিশের ব্যারাক, বিদ্যালয়ের ভবন, গুদাম, ছয়টি ব্যারাক ভবন, বাসভবন, রেস্ট হাউস, রোপওয়ের পাওয়ার হাউসের দরজা-জানালা, ছাদের টিন, লোহার অ্যাঙ্গেল থেকে শুরু করে বহনযোগ্য সব কিছু নিয়ে গেছে।”

রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, ভোলাগঞ্জ থেকে ছাতক পর্যন্ত ১৯ দশমিক ২০ কিলোমিটার রোপওয়ের নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৯৬৪ সালে। ব্রিটিশ রোপওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি এটি নির্মাণ করেছিল।

১৯৭০ সালে নির্মাণকাজ শেষ হলে জলযানের বিকল্প হিসেবে ১১৯টি খুঁটির মাধ্যমে শুরু হয় পাথর পরিবহন। এই রোপওয়ের বার্ষিক পাথর পরিবহন সক্ষমতা ১২ লাখ ঘনফুট।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় রোপওয়েটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে মেরামত করে ১৯৮০ সালে ফের এটি চালু করা হয়। সচল ছিল ২০১৩ সাল পর্যন্ত। ওই বছরের ৩১ ডিসেম্বর শেষবার এটি পাথর পরিবহন করে।

 

ঝুঁকিতে ধলাই সেতু

কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার উত্তর রনিখাই ও পূর্ব ইসলামপুরকে এক সঙ্গে যুক্ত করতে ২০০৩ সালে ১২ কোটি ৩১ লাখ ৫০ হাজার টাকা খরচ করে নির্মাণ করা হয় ধলাই সেতু। সেতুর গোড়া থেকে অবাধে বালু উত্তোলনের ফলে সেটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। অনেক স্থানে পিলার থেকে মাটি সরে গেছে।

সম্প্রতি সেখানে গিয়ে দেখা যায়, সেতুর গোড়া থেকে বালু উত্তোলন করে বারকি নৌকায় বোঝাই করা হচ্ছে। পিলারের গোড়া থেকে মাটি সরে বড় গর্ত তৈরি হয়েছে।

৪৩৪ দশমিক ৩৫ মিটার দীর্ঘ ও ৯ দশমিক ৫ মিটার প্রস্থের সেতুটি ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরে চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। সেতুর স্থায়িত্ব ধরা হয় ৭৫ বছর। এই সেতু দিয়ে অর্ধ লাখ মানুষ সরাসরি সড়ক যোগাযোগের আওতায় আসে।

পাশাপাশি দেশের সর্ববৃহৎ ভোলাগঞ্জ কোয়ারি থেকে পাথর পরিবহন সহজতর হয়। এ ছাড়া এই সেতু দিয়ে গোয়াইনঘাট উপজেলার সঙ্গেও যাতায়াত সহজ হয়।

সেতুর নিচ থেকে বালু উত্তোলনের ঘটনায় ১২ মার্চ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ধলাই নদের পূর্ব পারের বাসিন্দা মো. ফয়জুর রহমান জেলা প্রশাসক বরাবর একটি স্মারকলিপি দেন।

তবে তাতে কোনো কাজ হয়নি বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ফয়জুর। তিনি বলেন, “দেখা গেছে, এসিল্যান্ড অভিযানে আসার আগে বালুখোকোরা খবর পেয়ে যায়। প্রশাসনের লোকেরাই বলে দেয়, তারা আসতেছে। এরকম রের্কডও আমার কাছে আছে।”

সড়ক ও জনপথ-সওজ সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী আমির হোসেন বলেন, “ধলাই সেতুর গোড়া থেকে বালু উত্তোলনের বিষয়টি শুনেছি। সেতুটির অবস্থা দেখতে কর্মকর্তা যাবেন। উনি দেখে আসার পর বলা যাবে সেতুটির প্রকৃত অবস্থা কী।”

এ ব্যাপারে সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বলেন, “ব্রিজের পাশে প্রশাসন নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। ব্রিজ রক্ষার বিষয়ে সড়ক বিভাগকে জানানো হয়েছে। তারাও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।”

 

প্রশাসনের প্রতি ক্ষোভ

অবাধে বালু-পাথর লুটপাট হলেও প্রশাসন কোনো ভূমিকা নিতে পারছে না বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বাপার সিলেট জেলার সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম চৌধুরী কিম।

তিনি বলেন, “দুই কারণে এটা হতে পারে। একটা হচ্ছে, এখানকার সম্পদের অনেক মূল্য। এই টাকার অংশ সরকারের লোকজনের কাছে যায়। আর তারা যদি টাকা না নিয়ে থাকেন, তাহলে তারা এমন কোনো শক্তি আছে যাদের কাছে তারা পরাজিত। উনারা তাদের নাম প্রকাশ করতে পারছেন না।

“তাহলে এই লুটপাট কারা করছে? উনারা (প্রশাসনের লোকজন) বলেন যে, রাজনৈতিক দল বা এই চাঁদাবাজ গোষ্ঠী এই লুটেরা গোষ্ঠী এটা করছে, আমরা তাদেরকে প্রতিহত করতে পারছি না।”

কিম বলেন, “এই লুটপাট নিয়ে সিলেট জেলা প্রশাসকের কাছে অসংখ্য মিডিয়া থেকে প্রশ্ন করা হচ্ছে। আমিও নিজে তার কাছে ব্যক্তিগতভাবে অসংখ্য জায়গায় অনেক লুটপাটের বিষয়, পরিবেশ ধ্বংসের নানান তথ্য পাঠাচ্ছি। কিন্তু পদক্ষেপ তো খুবই গৌণ। এমনকি লুটপাট বন্ধ করতে হলে তো আলোচনা করতে হবে, সে পদক্ষেপ নিতে হবে। উনারা সেই কথাগুলো কোনোভাবেই জানাচ্ছেন না।”

এ ব্যাপারে জানতে ৭ মে বিকালে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আজিজুন্নাহারের কার্যালয়ে গেলে তিনি এই প্রতিবেদককে প্রশ্ন করেন, “কাকে জানিয়ে এখানে এসেছেন?”

কার কাছে জানাতে হবে প্রশ্ন করলে ইউএনও বলেন, “না, আপনারা আসতেই পারেন।”

তবে তিনি বালু-পাথর লুটপাট নিয়ে ক্যামেরা বা অডিও রেকর্ডারের সামনে কথা বলতে রাজি হননি।

আজিজুন্নাহার বলছিলেন, “আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। গত কয়েকদিন আগে বাংকার এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে নয়জনকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।”

তবে এখান থেকে কী পরিমাণ পাথর লুটপাট হয়েছে তার কোনো তথ্য নেই বলে জানান ইউএনও।

সিলেট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদও বলেন, “আমরা পরিমাপ করতে পারি নাই। বিএমডির সঙ্গে কথা বলেতে হবে।”

নিউজটি শেয়ার করুন