১০:৪২ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫

সিলেটের বালুমহালে ইজারার আগে হয় না মূল্যায়ন, উত্তোলনে উপেক্ষিত শর্ত

অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট সময়ঃ ০৮:২৯:৩৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • / ২৬ বার পড়া হয়েছে।

মহালের নির্ধারিত এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ ও প্রতিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিনা বা অবৈধভাবে বালু তোলা অব্যাহত আছে কিনা–এসব বিষয় যথাযথভাবে যাচাই ছাড়াই ইজারা দেওয়া হচ্ছে বালুমহাল। কোনো মহালের বিরুদ্ধে আবেদন করা হলে মূল্যায়ন করা হয় না বলেও অভিযোগ রয়েছে।

বালুমহাল ইজারার ১০ নম্বর শর্তে বলা হয়েছে, সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা, পরিবেশ, রাস্তাঘাট-হাটবাজার, চা বাগান ও সড়কের ক্ষতি হয় এমন স্থানে বালু উত্তোলন করা যাবে না। পরিবেশ বিধ্বংসী পদ্ধতিতে বালু উত্তোলন করা যাবে না বা পরিবেশের ক্ষতি হলে ইজারা তাৎক্ষণিক বাতিল করা হবে। ৯ নম্বর শর্তে আছে–পাম্প, ড্রেজিং বা অন্য কোনো মাধ্যমে বালু উত্তোলন করা যাবে না। নদীর তীরে রাখা যাবে না বালু। মহালের আয়তন বাড়ানো-কমানো বা ক্ষতিসাধন বা পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করা যাবে না। ১২ নম্বর শর্তে বলা হয় বালু ছাড়া অন্যকিছু উত্তোলন করা যাবে না। তবে বরাবরই এসব শর্ত লঙ্ঘন করে প্রতি বছর যন্ত্রের সাহায্যে এবং ইজারা বিধিবহির্ভূতভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে।

শুধু তাই নয়, এসব বালুমহাল ইজারার আগে করা হয় না অ্যাসেসমেন্ট বা মূল্যায়ন। আদৌ সেখানে বালু আছে কিনা, থাকলেও পরিবেশের কোনো ক্ষতি হবে কিনা বা ইজারার পর ক্ষতি হয়েছে কিনা সে বিষয়ে কোনো নজরদারি বা মূল্যায়ন না করেই বছরের পর বছর দেওয়া হচ্ছে বালুমহাল ইজারা। ইজারাদাররা অনেক মহালে বালু সংকট রয়েছে জেনেও বহির্ভূত এলাকার আশায় সরকারি অঙ্কের দ্বিগুণ টাকা দিয়ে ইজারা নিচ্ছেন। সূত্র জানায়, এমন পরিস্থিতিতে এবার প্রশাসন পাথরের পর বালুর লাগাম টেনে ধরলে অনেক ইজারাদার পড়েন বেকায়দায়।

স্থানীয় বাসিন্দা ও সংশ্লিষ্টদের তথ্য মতে, ইজারার শর্ত না মানা ও মহালের অবস্থা পর্যবেক্ষণ না করার কারণে অনেক এলাকায় ভেঙে যাচ্ছে নদীর পাড়, বসতবাড়ি, স্থাপনা। বালু ও পাথরের রাজ্য সিলেট জেলায় ৭টি পাথর কোয়ারি ও ৪০টি বালুমহাল রয়েছে। পাথর কোয়ারি বছরের পর বছর ধরে ইজারা বন্ধ থাকলেও উত্তোলন থেমে থাকেনি। সম্প্রতি সাদাপাথরকাণ্ডে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন বন্ধ করে দিয়েছে প্রশাসন। বালুমহাল প্রতি বছরই ইজারা দেওয়া হচ্ছে। এবারও ১৪৩২ বাংলা সনের জন্য বালুমহাল ইজারা দিয়েছে জেলা প্রশাসন। এসব বালুমহাল বছরের পর বছর ইজারা দিয়ে এলেও কোনো মূল্যায়ন হয় না। অথচ কোনো মহালে বালু নেই, কোনো মহালে রয়েছে সংকট–এমনকি পরিবেশ-প্রতিবেশের পরিবর্তন হয়েছে একাধিক মহালে। এ অবস্থায় মহাল ইজারায় কোনো পরিবর্তন আসেনি। ফলে মানা হয় না ইজারার শর্তাবলি। ইজারাবহির্ভূত জায়গা থেকে বালু উত্তোলনের আশায় বড় অঙ্কের রাজস্ব দিয়ে ইজারা নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এক জায়গা ইজারা নিয়ে অন্য জায়গা থেকে বালু উত্তোলনের সুযোগে তারা ইজারা নিচ্ছেন।

চলতি বছরের ২৭ আগস্ট জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে ইজারার বাইরে কোনো স্থান থেকে বালু উত্তোলনে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ইজারার বাইরে যাতে কেউ উত্তোলন না করতে পারে সেজন্য অভিযান ও জরিমানাও করা হচ্ছে। সর্বশেষ চলতি মাসের ১০ তারিখ ধলাই নদীতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের অভিযোগে ১১টি নৌকা ও ৮টি লিস্টার মেশিন ধ্বংস করা হয়। তার আগে জাফলংয়ে ১৪ জনকে কারাদণ্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। তারপরও জৈন্তাপুরের লালাখাল, কোম্পানীগঞ্জের সুনাই নদীসহ একাধিক স্থান থেকে অবৈধভাবে চলছে বালু উত্তোলন। ইজারাভুক্ত এলাকায় বালু না থাকা বা সংকট, ইজারাবহির্ভূত এলাকা থেকে উত্তোলন না করতে পারার কারণে আগের তুলনায় কমে গেছে নৌকা-বাল্কহেড। কমেছে টোল আদায়ের পরিমাণও। আগে প্রতিদিন বিভিন্ন মহাল ও স্থান থেকে প্রায় দেড় কোটি ঘনফুট বালু উত্তোলন হলেও এখন ৭০ থেকে ৮০ লাখ ঘনফুটে নেমে গেছে। এসব বালু প্রতি ঘনফুট ২৫ থেকে ৫৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। বালুখাতে এখনও প্রতিদিন কম করে হলেও ২০ কোটি থেকে ২৫ কোটি টাকা লেনদেন হয়।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) শাখার তথ্য মতে, সিলেট জেলায় ৪০টি বালুমহালের মধ্যে ১৫টি ইজারা দেওয়া হয়েছে। ৫টি রয়েছে প্রক্রিয়াধীন। ১৫টি মহাল হচ্ছে– সিলেট মহানগরীর বড়ছড়া, মালনীছড়া ও তেলনীছড়া, সদরের তিলকপুর, বিয়ানীবাজারের আঙ্গুরা মোহাম্মদপুর, নয়া দুবাগ ও কুশিয়ারা দক্ষিণ, জকিগঞ্জের সুরমা নদী, নওয়াগাঁও, জৈন্তাপুরের সারি নদী-১ ও ২, বড়গাঙ, গোয়াইনঘাটের লেঙ্গুরা ও হাদারপাড় এবং কোম্পানীগঞ্জের ধলাই নদীর দক্ষিণ ও পিয়াইন নদী বালুমহাল। প্রক্রিয়াধীন আছে সদরের বড়চর আঙ্গারুয়া, জকিগঞ্জের বারহাল ইউনিয়নের নয়া দুবাগ, গোয়াইনঘাটের ১১৭ গোয়াইন নদী, হাজিপুর আহারকান্দি ও ফতেহপুর।

দেখা গেছে মহানগর এলাকার মালনীছড়া ও বড় ছড়ার সীমানার বাইরে থেকে বালু উত্তোলন হচ্ছে। ধলাই নদী ও পিয়াইন নদী, হাদারপাড় মহালে রয়েছে বালু সংকট। পিয়াইন নদীর ইজারার বাইরে উত্তোলন হচ্ছে। গোয়াইনঘাটের লেঙ্গুরা বালুমহাল ইজারা থাকলেও জাফলং, বাংলাবাজার, হাজীপুরসহ কয়েকটি স্থান থেকে বালু উত্তোল হচ্ছে। জৈন্তাপুরের বড়গাঁও ও সারি নদী-১ ও ২ ইজারা থাকলেও বালু উত্তোলন হচ্ছে শ্রীপুর রাংপানি নদী ও গোয়াইনঘাটের নলজুরী পাশে অবস্থিত খাঁসি নদী, বাওন হাওর ও শেওলার টুক নামক স্থান থেকে। সেখানে আবার ড্রেজার মেশিন ব্যবহার হচ্ছে। সারি নদীর ইজারাভুক্ত মহালে আবার সনাতন পদ্ধতিতে বালু উত্তোলন করতে দেখা গেছে। এছাড়া লেঙ্গুরা, হাদারপাড়, ধলাই সুরমা নওয়াগাঁও মহালেও যন্ত্র ব্যবহার হচ্ছে। মহাল এলাকায় পানি থাকায় ড্রেজিং মেশিনের সাহায্যে বালু উত্তোলন চলছে।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, সুরমা নদী নওয়াগাঁও বালুমহালের কারণে নদী-তীরবর্তী কানাইঘাট এলাকার বড়দেশ উত্তর, কায়স্থগ্রাম, ব্রাহ্মণ গ্রামের লোকজন নদীভাঙনের কবলে পড়েছে। গোয়াইনঘাটের হাদারপাড় বালুমহালের কারণে দয়ারবাজার থেকে বিছনাকান্দি পর্যন্ত বালু উত্তোলনের ফলে বেশ কিছু এলাকায় নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। বালুমহালে রয়েছে সংকট। ধলাই নদীতে বর্তমানে ইজারার বাইরে বালু উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। গত কয়েক বছরে স্থানীয় ঢালারপাড়সহ কয়েকটি এলাকার নদীর তীর ভেঙে গেছে।

ইজারা এলাকায় বালু সংকটের কথা স্বীকার করে ইজারাদার ব্যবসায়ী আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, ধলাই সেতুর অজুহাতে নানাভাবে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছেন তিনি। তাঁর ইজারাকৃত জায়গার মধ্যে ৮৮ একর জায়গাই সেতুর কারণে বাদ দেওয়ায় তিনি জেলা প্রশাসকের কাছে ইজারামূল্য ফেরতের আবেদন করেছেন। যন্ত্রের ব্যবহার সবসময় চলে আসছে বলে জানান তিনি।

কোম্পানীগঞ্জের সুনাই নদীর বালু মহাল ইজারা না থাকলেও নদীর নতুন জালিয়ারপাড়, ছনবাড়ি, বাহাদুরপুর, বৈশাকান্দি, নোয়াকোটসহ কয়েকটি এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে বালু উত্তোলন চলছে। সম্প্রতি বালু ও পাথরবিরোধী অভিযান শুরু হলে তা বন্ধ হয়ে যায়। তবে এখন রাতে ও ভোরবেলায় উত্তোলন চলছে। সারি-১ মহালটি প্রায় ৬ কোটি টাকায় ইজারা নেয় মেসার্স কামরুল ইসলাম চৌধুরী। মহালের অংশীদার মোমিনুল হক জানান, ছোট মেশিনের পাশাপাশি সনাতন পদ্ধতিতে তাদের মহাল থেকে বালু উত্তোলন হয়। মহালের কারণে ক্ষতি হচ্ছে না এবং ইজারার বাইরে কেউ বালু উত্তোলন করছে না উল্লেখ করে তিনি জানান, ইজারায় সরকারি দাম চাওয়া হয়। মহালের অবস্থা কী সেটি দেখা হয় না। প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে সরকারি দামের দ্বিগুণ টাকায় ইজারা নিতে হয়।

বড়গাং নদী বালুমহাল প্রসঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দা ও ফেরিঘাট পল্লী উন্নয়ন যুবসংঘের সাধারণ সম্পাদক রেজওয়ান করিম সাব্বির জানান, বড় গাং নদীর উৎসমুখ হতে প্রায় ৮০ শতাংশ এলাকায় ৮ মাস পানি থাকে না। সেখানে ড্রেজিং প্রয়োজন। ইজারা দেওয়া হয় কিন্তু ড্রেজিং করার অনুমতি নেই। সনাতন পদ্ধতিতে বালু উত্তোলনে নদীর কোনো ক্ষতি হয় না বরং খনন করা হলে নাব্য ফিরে আসে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ জানিয়েছেন, জেলা প্রশাসন থেকে মতামত চাওয়া হয় নদীর গভীরতা ও ক্ষতির বিষয়ে। বালু আছে কিনা সেটি তারা দেখেন। পাউবো শুধু পানির স্তর ও ক্ষতির বিষয় দেখে থাকে।

এ বিষয়ে সিলেটের নবাগত জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার আলম বলেন, পাথরের পর বালুও নিয়ন্ত্রণে আনা হচ্ছে। কেউ ইজারার বাইরে বালু উত্তোলন করলে ইজারা বাতিল করা হবে। তিনি ইজারার আগে বালুমহালের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে বলেন, আগামীতে এ বিষয়টি মাথায় রেখে ইজারা দেওয়া হবে। বিষয়টি খুবই জরুরি। সূত্র: সমকাল

নিউজটি শেয়ার করুন
ট্যাগসঃ

বিস্তারিত লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষণ করুন