০৭:২৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ অগাস্ট ২০২৫

সুনামগঞ্জে নৌকাবাইচ দেখতে মানুষের ঢল

সিলেট ব্যুরো
  • আপডেট সময়ঃ ০৭:৫২:১০ অপরাহ্ন, শনিবার, ৯ অগাস্ট ২০২৫
  • / ৩০ বার পড়া হয়েছে।

‘কোন মিস্তরি নাও বানাইলো, এমন দেখা যায়, ঝিলমিল-ঝিলমিল করে রে ময়ুরপঙ্খি নাও…।’ বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের বিখ্যাত গানের সঙ্গে ঢোল বাজছে, কাঁসর বাজছে, বাজছে খোল-করতাল। রং বেরঙের বিভিন্ন ধরনের পোশাকে নাওয়ের মাঝি-মাল্লার কণ্ঠের গান ও দর্শকসারিতে ছিল অফুরন্ত আনন্দ উল্লাস।

হাওর-ভাটির ঐতিহ্যের নৌকাবাইচে এমন পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল বাউল আব্দুল করিমেরই এলাকা সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার শ্যামারচরের মরা সুরমা নদীতে। প্রায় লাখো দর্শকের উপস্থিতে মরা সুরমায় জোয়ার এসেছিল। নদীর চরনারচর থেকে শ্যামারচর বাজারের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা হয়।

জানা যায়, নানা রঙরের ১০টি নৌকা দিয়ে হাওর-ভাটির শতবর্ষের ঐতিহ্যের নৌকাবাইচের আয়োজন করা হয়েছিল। পার্শ্ববর্তী এলাকার বাসিন্দা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনিরের সহযোগিতায় গতকাল শুক্রবার বিকেলে মরা সুরমা নদীতে এই নৌকাবাইচটি হয়।

নৌকাবাইচে সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও সিলেটের বিভিন্ন স্থান থেকে সোনার তরী, আইয়ুব শাহ তরী, হামজা তরী, স্বপের তরী-১ ও ২, ইশানের তরি, গরীবের তরী, বীর পবন, বীর বাংলা, মায়ের দোয়া নামের নৌকাগুলো মরা সুরমার বুকে ঢেউ তোলে ছুটে চলছে। আর নেচে-গেয়ে নদীর দুই তীরে হই-হই করে আনন্দ উল্লাস করেছেন বিভিন্ন বয়সের সারি সারি নারী-পুরুষ, শিশু দর্শক।

শুক্রবার (৮ আগস্ট) সকাল থেকেই সুরমার দুই পাড়ে জড়ো হয়েছিলেন দর্শকরা। শ্যমার বাজারের পাশের সুরমা নদীর সেতুটি সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত দর্শকে ছিল ঠাসা। দর্শকদের কেউ ছিলেন নৌকায়, কেউ তীড়ে, কেউবা গাছের ডালে, আবার ঘরের চালে। সবাই অপেক্ষা করছিলেন রোমাঞ্চকর সেই মুহুর্তের। সিলেট ও আশপাশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে দর্শকরা উপস্থিত হয়েছিলেন নৌকাবাইচ দেখতে। প্রতিযোগিতা শেষে বিজয়ী তিনটি নৌকা আইয়ুব শাহ তরী, স্বপের তরী ও ইশানের তরীকে স্বর্ণের হরিণ, স্বর্ণের প্রজাপ্রতি ও মোটরসাইকেল উপহার দেওয়া হয়েছে।

উপস্থিত সুনামগঞ্জ শহরের ষোলঘর বাসিন্দা মনোয়ার চৌধুরী বলেন, আমি আগে নৌকাবাইচ দেখিনি। শ্যামারচরের নৌকাবাইচ দেখে খুব ভাল লেগেছে। নৌকাবাইচ দেখতে সকাল থেকেই হাজার হাজার মানুষ রোদ-বৃষ্টি উপক্ষো করে বিকেলে নৌকাবাইচ দেখেছেন। এমন আয়োজন প্রতিটি এলাকায় করা প্রয়োজন।

নৌকাবাইচ দেখতে সিলেট শহর থেকে পরিবার নিয়ে এসেছিলেন দিরাইয়ের পেরুয়া গ্রামের বাসিন্দা হেপী সরকার। একটি ছোট নৌকায় উঠে বাইচ দেখেছেন তারা। বাইচ দেখার প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, অনেক বছর পরে একটি সুন্দর নৌকাবাইচ দেখলাম। সকাল থেকেই উত্তেজনায় ছিলাম কোন সময়ে শুরু হবে বাইচ। শুধু নৌকাবাইচ দেখার জন্য সিলেটে থেকে আসছি। অনেক ধন্যবাদ আইনজীবী শিশির মনিরকে। এভাবে যেন প্রতি বছরই আয়োজন করা হয়।

শাল্লা উপজেলার মনুয়া গ্রামের বাসিন্দা আনিসুল হক চৌধুরী মুন জামালগঞ্জে একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকুরি করেন। নৌকাবাইচ দেখার সময় তিনি বলেন, দাদার কাছে নৌকাবাইচের গল্প শুনেছি। কিন্তু নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা স্বচক্ষে দেখিনি কখনও। আইনজীবী শিশির মনিরের আয়োজনে জীবনের প্রথম সুন্দর প্রতিযোগিতা উপভোগ করলাম। আমার পরিচিত অনেকেই হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা ও সিলেটের বিভিন্ন এলাকা থেকে এসেছিলেন নৌকাবাইচ দেখতে এখানে এসেছেন।

জামালগঞ্জ উপজেলার গজারিয়া গ্রামের ‘মায়ের দোয়া’ নৌকার মাঝি নূর উদ্দিন ও আবু বক্কর বলেন, ‘যেসব এলাকাতে নৌকাবাইচ হয়, আমরা সেখানেই যাই। তবে এত সুন্দর আয়োজন কোথাও হয় নাই। অনেক দর্শক হয়েছে, এতে মানুষ কোথাও দেখিনি আমরা।’

নৌকাবাইচের আয়োজক সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, প্রতিযোগিতার মূল উদ্দেশ্য হলো গ্রামীণ ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনা। সুস্থ্য সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা ছড়িয়ে দেওয়া। যেন মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্য এবং সম্প্রতি বৃদ্ধি পায়। একে অন্যের প্রতি সম্মান এবং ভালোবাসা যেন বৃদ্ধি পায়। এর মাধ্যমে যেন ভাটি বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে শান্তির বাণী ছড়িয়ে পড়ে। যুবসমাজ যেন মাদকাসক্ত থেকে মুক্ত হয়ে ক্রিয়েটিভ এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতা সম্পন্ন সুন্দর কাজে যেন যুক্ত হয়। আগামীতে লাঠি খেলা ও হাডুডু খেলার আয়োজন করবেন বলে জানান তিনি।

নিউজটি শেয়ার করুন
ট্যাগসঃ

বিস্তারিত লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষণ করুন

সুনামগঞ্জে নৌকাবাইচ দেখতে মানুষের ঢল

আপডেট সময়ঃ ০৭:৫২:১০ অপরাহ্ন, শনিবার, ৯ অগাস্ট ২০২৫

‘কোন মিস্তরি নাও বানাইলো, এমন দেখা যায়, ঝিলমিল-ঝিলমিল করে রে ময়ুরপঙ্খি নাও…।’ বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের বিখ্যাত গানের সঙ্গে ঢোল বাজছে, কাঁসর বাজছে, বাজছে খোল-করতাল। রং বেরঙের বিভিন্ন ধরনের পোশাকে নাওয়ের মাঝি-মাল্লার কণ্ঠের গান ও দর্শকসারিতে ছিল অফুরন্ত আনন্দ উল্লাস।

হাওর-ভাটির ঐতিহ্যের নৌকাবাইচে এমন পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল বাউল আব্দুল করিমেরই এলাকা সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার শ্যামারচরের মরা সুরমা নদীতে। প্রায় লাখো দর্শকের উপস্থিতে মরা সুরমায় জোয়ার এসেছিল। নদীর চরনারচর থেকে শ্যামারচর বাজারের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা হয়।

জানা যায়, নানা রঙরের ১০টি নৌকা দিয়ে হাওর-ভাটির শতবর্ষের ঐতিহ্যের নৌকাবাইচের আয়োজন করা হয়েছিল। পার্শ্ববর্তী এলাকার বাসিন্দা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনিরের সহযোগিতায় গতকাল শুক্রবার বিকেলে মরা সুরমা নদীতে এই নৌকাবাইচটি হয়।

নৌকাবাইচে সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও সিলেটের বিভিন্ন স্থান থেকে সোনার তরী, আইয়ুব শাহ তরী, হামজা তরী, স্বপের তরী-১ ও ২, ইশানের তরি, গরীবের তরী, বীর পবন, বীর বাংলা, মায়ের দোয়া নামের নৌকাগুলো মরা সুরমার বুকে ঢেউ তোলে ছুটে চলছে। আর নেচে-গেয়ে নদীর দুই তীরে হই-হই করে আনন্দ উল্লাস করেছেন বিভিন্ন বয়সের সারি সারি নারী-পুরুষ, শিশু দর্শক।

শুক্রবার (৮ আগস্ট) সকাল থেকেই সুরমার দুই পাড়ে জড়ো হয়েছিলেন দর্শকরা। শ্যমার বাজারের পাশের সুরমা নদীর সেতুটি সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত দর্শকে ছিল ঠাসা। দর্শকদের কেউ ছিলেন নৌকায়, কেউ তীড়ে, কেউবা গাছের ডালে, আবার ঘরের চালে। সবাই অপেক্ষা করছিলেন রোমাঞ্চকর সেই মুহুর্তের। সিলেট ও আশপাশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে দর্শকরা উপস্থিত হয়েছিলেন নৌকাবাইচ দেখতে। প্রতিযোগিতা শেষে বিজয়ী তিনটি নৌকা আইয়ুব শাহ তরী, স্বপের তরী ও ইশানের তরীকে স্বর্ণের হরিণ, স্বর্ণের প্রজাপ্রতি ও মোটরসাইকেল উপহার দেওয়া হয়েছে।

উপস্থিত সুনামগঞ্জ শহরের ষোলঘর বাসিন্দা মনোয়ার চৌধুরী বলেন, আমি আগে নৌকাবাইচ দেখিনি। শ্যামারচরের নৌকাবাইচ দেখে খুব ভাল লেগেছে। নৌকাবাইচ দেখতে সকাল থেকেই হাজার হাজার মানুষ রোদ-বৃষ্টি উপক্ষো করে বিকেলে নৌকাবাইচ দেখেছেন। এমন আয়োজন প্রতিটি এলাকায় করা প্রয়োজন।

নৌকাবাইচ দেখতে সিলেট শহর থেকে পরিবার নিয়ে এসেছিলেন দিরাইয়ের পেরুয়া গ্রামের বাসিন্দা হেপী সরকার। একটি ছোট নৌকায় উঠে বাইচ দেখেছেন তারা। বাইচ দেখার প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, অনেক বছর পরে একটি সুন্দর নৌকাবাইচ দেখলাম। সকাল থেকেই উত্তেজনায় ছিলাম কোন সময়ে শুরু হবে বাইচ। শুধু নৌকাবাইচ দেখার জন্য সিলেটে থেকে আসছি। অনেক ধন্যবাদ আইনজীবী শিশির মনিরকে। এভাবে যেন প্রতি বছরই আয়োজন করা হয়।

শাল্লা উপজেলার মনুয়া গ্রামের বাসিন্দা আনিসুল হক চৌধুরী মুন জামালগঞ্জে একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকুরি করেন। নৌকাবাইচ দেখার সময় তিনি বলেন, দাদার কাছে নৌকাবাইচের গল্প শুনেছি। কিন্তু নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা স্বচক্ষে দেখিনি কখনও। আইনজীবী শিশির মনিরের আয়োজনে জীবনের প্রথম সুন্দর প্রতিযোগিতা উপভোগ করলাম। আমার পরিচিত অনেকেই হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা ও সিলেটের বিভিন্ন এলাকা থেকে এসেছিলেন নৌকাবাইচ দেখতে এখানে এসেছেন।

জামালগঞ্জ উপজেলার গজারিয়া গ্রামের ‘মায়ের দোয়া’ নৌকার মাঝি নূর উদ্দিন ও আবু বক্কর বলেন, ‘যেসব এলাকাতে নৌকাবাইচ হয়, আমরা সেখানেই যাই। তবে এত সুন্দর আয়োজন কোথাও হয় নাই। অনেক দর্শক হয়েছে, এতে মানুষ কোথাও দেখিনি আমরা।’

নৌকাবাইচের আয়োজক সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, প্রতিযোগিতার মূল উদ্দেশ্য হলো গ্রামীণ ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনা। সুস্থ্য সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা ছড়িয়ে দেওয়া। যেন মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্য এবং সম্প্রতি বৃদ্ধি পায়। একে অন্যের প্রতি সম্মান এবং ভালোবাসা যেন বৃদ্ধি পায়। এর মাধ্যমে যেন ভাটি বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে শান্তির বাণী ছড়িয়ে পড়ে। যুবসমাজ যেন মাদকাসক্ত থেকে মুক্ত হয়ে ক্রিয়েটিভ এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতা সম্পন্ন সুন্দর কাজে যেন যুক্ত হয়। আগামীতে লাঠি খেলা ও হাডুডু খেলার আয়োজন করবেন বলে জানান তিনি।

নিউজটি শেয়ার করুন