হাওর, নদী ও পাহাড় মিলে নজর কাড়ছে সুনামগঞ্জে

- আপডেট সময়ঃ ০২:৪৫:৪৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৫ অগাস্ট ২০২৫
- / ২৮ বার পড়া হয়েছে।

রূপে গুণে অনন্য হাওরাঞ্চল। বর্ষায় জল থই থই চারদিক, আবার হেমন্তে দিগন্তবিস্তৃত সবুজ ফসলের মাঠ। দুই সময়ে দুই রূপ। এই হাওরে বেড়ানোর কথা ভাবলেই এখন সুনামগঞ্জের নামটি সবার ভাবনায় চলে আসে। তাই সুনামগঞ্জকে অনেকেই বলেন ‘হাওরকন্যা’। অবশ্য এর পেছনে আছে নয়নাভিরাম টাঙ্গুয়ার হাওর।
সুনামগঞ্জে হাওর আছে শতাধিক। আছে আরও বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান। হাওর, নদী, পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্যের মেলবন্ধন সুনামগঞ্জকে পর্যটকদের কাছে বিশেষভাবে পরিচিতি দিয়েছে।
এখন জলভরা হাওরে নৌকায় ঘুরে বেড়ানোর মজাই আলাদা। কখনো তুমুল বৃষ্টি, আবার কখনো আকাশে ঝলমলে রোদের খেলা। উত্তরে মেঘালয় পাহাড়ের হাতছানি যে কাউকে মুগ্ধ করবে। এই সময় হাওর কখনো উথালপাতাল, আবার কখনো শান্ত সিগ্ধ, সুনসান। কিন্তু হাওরের এই জেলায় হাওর ছাড়াও পর্যটকদের মুগ্ধ করার মতো আরও বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান আছে। যেগুলো ঘুরে দেখতে পারেন পর্যটকেরা। সুনামগঞ্জ শহরে পা রেখেই ইচ্ছা করলে মিনিট পাঁচেকের মধ্যে চলে যাওয়া যাবে মরমি সাধক হাসন রাজার বাড়িতে। পৌর শহরের তেঘরিয়া এলাকায় সুরমা নদীর তীরে এই বাড়ির অবস্থান। হাসন রাজা মিউজিয়াম ঘুরে দেখার পর তাঁর বাড়ির শান–বাঁধানো পুকুর, টিনশেডের পুরোনো সেই বৈঠকখানা দেখা যায়। সময়ের স্রোতে ক্ষয়ে গেছে সেই ঘর। হাসন রাজা তো নিজেই বলে গেছেন, ‘লোকে বলে, বলে রে ঘরবাড়ি ভালা না আমার, কি ঘর বানাইমু আমি শূন্যেরও মাঝার…।’
শুধু কি হাসন রাজা, জেলার দিরাই উপজেলার উধানধল গ্রামে শুয়ে আছেন বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিম। বরাম হাওরের জল-ঢেউয়ের সঙ্গে খেলতে খেলতে চলে যাওয়া যায় সেখানে। বাউল করিমের সমাধি, সংগীতালয়, কালনী নদীর তীরে ঘুরতে ভালো লাগবে। কালনী নদীর তীরে যেন করিমের মায়া জড়িয়ে আছে। জগন্নাথপুর উপজেলায় আছে বৈষ্ণব সাধক রাধারমণ দত্তের বাড়ি। সেখানেও যাওয়া যায়।
হাওরের এই জেলায় একসময় হাসন রাজা ছাড়াও আরও অনেক জমিদার রাজত্ব করেছেন। এখন জমিদারি নেই, নেই জমিদারও। তবে কালের সাক্ষী হয়ে আছে তাঁদের বাড়ি, মহল। এগুলো ঘুরলে ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতি যে কারও টান বাড়বে। সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার গৌরারং জমিদারবাড়ি, ধর্মপাশা উপজেলার সুখাইড় জমিদারবাড়ি, জগন্নাথপুর উপজেলার পাইলগাঁও জমিদারবাড়ি, দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া জমিদারবাড়ি, তাহিরপুরের হলহলিয়া জমিদারবাড়ি, দোয়ারাবাজার উপজেলা দোহালিয়া জমিদারবাড়িতে অনেকেই ঘুরতে যান।
সুনামগঞ্জে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজরিত দুটি ঐতিহাসিক স্থান আছে। একটি হলো সদর উপজেলা সীমান্তবর্তী ডলুরা, অন্যটি দোয়ারাবাজার উপজেলার বাঁশতলা (হকনগর)। একেবারে সীমান্তঘেঁষা ছায়াময় ডলুরায় একই স্থানে আছে মহান মুক্তিযুদ্ধের ৪৮ জন বীর শহীদের সমাধি। এলাকাটি বেশ মনোরম। সমাধি এলাকাতেই আছে পর্যটকদের বিশ্রাম নেওয়ার ব্যবস্থা। পাশেই সুনামগঞ্জের প্রথম সীমান্ত হাট। এখন যদিও হাট বন্ধ। সমাধি এলাকার পশ্চিমে চলতি নদী। দোয়ারাবাজার উপজেলার সীমান্তবর্তী টিলায় ঘেরা বাঁশতলা এলাকাটি মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিল মুক্তিসেনাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। এই এলাকার তিন দিকে ভারত। এখানে আছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ১৭ জনের সমাধি। এখানে একটি দৃষ্টিনন্দন শহীদ স্মৃতিসৌধ আছে। পাশেই পাহাড়ের ওপর ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর গ্রাম ঝুমগাঁও। পরিচ্ছন্ন সাজানো–গোছানো গ্রামটি দেখতে অনেকেই সেখানে যান। শহীদ সমাধি এলাকায় পর্যটকদের জন্য একটি গেস্টহাউস নির্মাণ করা হয়েছে।
ভৌগোলিক দিক থেকে হাওর দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে আলাদা। মানুষের জীবনযাত্রা ও আর্থসামাজিক পরিস্থিতিও এখানে ভিন্ন। বছরের বেশির ভাগ সময় হাওর থাকে জলমগ্ন। থই থই জলের ওপর তখন ছোট ছোট গ্রামগুলো ভাসে দ্বীপের মতো। আবার শুকনা মৌসুমে মাইলের পর মাইল হাঁটা পথ। মানুষের যোগাযোগ-যাতায়াত এখানে কঠিন। এই কঠিন যোগাযোগচিত্র বোঝাতে বলা হয়ে থাকে ‘বর্ষায় নাও, আর হেমন্তে পাও’। তবে এখন পরিস্থিতি অনেকটা বদলেছে। মানুষের জন্য যোগাযোগ সহজ করার চেষ্টা হচ্ছে। পাশাপাশি নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে হাওরকেন্দ্রিক পর্যটন সম্ভাবনা বিকাশের।
সুনামগঞ্জে প্রতিবছর যেসব পর্যটক ঘুরতে আসেন তাঁদের বেশির ভাগই তাহিরপুর উপজেলায়। এই উপজেলায় পাশাপাশি বেশ কয়েকটি দর্শনীয় স্থান আছে, যেগুলো পর্যটকদের কাছে খুবই প্রিয়। পর্যটকেরা সহজেই এসব ঘুরে দেখতে পারেন। এই উপজেলায় এলে একসঙ্গে টাঙ্গুয়ার হাওর, এই হাওরের উত্তর পাড়ের শহীদ সিরাজ লেক, নিলাদ্রী পার্ক, স্বাধীনতা উপত্যকা, লাকমাছড়া, টেকেরঘাটের নয়নাভিরাম ছোট ছোট টিলা, স্মৃতিসৌধ, মহেষখলার মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ, বারিক টিলা, শাহ আরেফিন (র.)–এর আস্তানা, শ্রী অদ্বৈত মহাপ্রভুর মন্দির, শিমুল বাগান এবং যাদুকাটা নদীর অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।
টেকেরঘাট এলাকায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি কটেজ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। আছে পুরোনো আরেকটি গেস্টহাউস আগে থেকে যোগাযোগ করে এলে এসবে থাকতে পারেন পর্যটকেরা। আবার ইচ্ছা করলে সকালে গিয়ে সারা দিন ঘুরে সন্ধ্যা নামার আগেই ফেরা যায় জেলা শহরে। তবে এখন টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটকদের জন্য হাউসবোট চালু হওয়ায় অনেকেই টাঙ্গুয়ার হাওরে হাউসবোটে রাতযাপন করেন। রাতে হাওরপাড়ের টেকেরঘাট এলাকায় এসব হাউসবোট নোঙর করে। পাশাপাশি সুনামগঞ্জ সদর উপজেলায় চলতি নদী, সুরমা নদী ও দেখার হাওরে নৌকার ঘুরতে পারেন পর্যটকেরা।
সুনামগঞ্জের ছাতকে আছে দেশের প্রথম রাষ্ট্রায়ত্ত ছাতক সিমেন্ট কারখানা; বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার মিছাখালী রাবার ড্যাম এলাকা; ধর্মীয় স্থানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য শান্তিগঞ্জের পাগলা বড় মসজিদ, তাহিরপুরের পণতীর্থ ধাম, আছিম শাহের মাজার, সদর উপজেলার সীমান্তবর্তী নারায়ণতলা মিশন এলাকায় গেলে ভালো লাগবে।
এই জেলার পর্যটন বিকাশে সরকারিভাবে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটকদের জন্য সরকারি ব্যবস্থাপনায় নৌকা তৈরি করা হচ্ছে। পর্যটকদের ভ্রমণকালে হাওরের প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় সচেতনতামূলক নানা প্রচারণা ও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বারিক টিলা, শহীদ সিরাজ লেকে পর্যটকদের বিশ্রামের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশাপাশি এ জেলায় থাকা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান, ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশনগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সুনামগঞ্জের দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখতে হলে আগে থেকেই যোগাযোগ করে আসা ভালো। সুনামগঞ্জ শহর থেকে জেলার যেকোনো স্থানে ঘুরে আবার দিনে দিনে শহরে ফেরার সুযোগ আছে। তবে এটির জন্য আগে থেকেই ব্যবস্থা করতে হবে। আর হাওরে ঘুরতে হলে ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হবে। হাওরে নামতে হলে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। সাঁতার জানা না থাকলে অবশ্যই লাইফ জ্যাকেট সঙ্গে নিতে হবে। শিশুদের প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। ঝড়ের দিনে হাওরে না যাওয়াই ভালো।