০৭:৪৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ভূমিকম্পের ‘ভয়াবহ’ ঝুঁকিতে সিলেট

অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট সময়ঃ ০৩:০৪:৫০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • / ৩৭ বার পড়া হয়েছে।

ভূমিকম্পের ‘ডেঞ্জার জোন’ বা ‘ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল’ সিলেট। একাধিক চ্যুতি সক্রিয় থাকায় সিলেটকে ভূমিকম্পের ‘ডেঞ্জার জোন’ চিহিৃত করে সতর্কবার্তা দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এরই মধ্যে সর্বশেষ রোববার বিকাল ৫টা ১১ মিনিটে ভূমিকম্পের ঝাঁকুনিতে কেঁপে উঠে সিলেট। ৫ দশমিক ৫ মাত্রার এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল সিলেট থেকে ১৯৩ কিলোমিটার দূরে ভারতের আসামের উদালগুড়ি জেলা ‘কপিলি ফল্ট’ জোনে। ভূমিকম্পের পর সোমবার বিকাল পর্যন্ত টানা ২৪ ঘণ্টায় আরও সাতটি ‘আফটারশক’ রেকর্ড করা হয়।

আসামের এ ভূমিকম্প সিলেটের জন্য সতর্কবার্তা বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এগুলো স্বাভাবিক হলেও আসল উদ্বেগ লুকিয়ে আছে কপিলি ফল্টে জমে থাকা বিপুল শক্তিতে।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুর ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জহির বিন আলম বলেন, কপিলি ফল্ট ডাউকি ফল্টের তুলনায় অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। ডাউকিতে অতীতে একাধিক ভূমিকম্প হয়ে শক্তি আংশিকভাবে বের হয়ে গেছে। কিন্তু কপিলিতে এখনো বিপুল শক্তি জমে আছে, যা যে কোনো সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প ঘটাতে পারে।

তিনি আরও বলেন, জাপানের গবেষকরা দীর্ঘদিন ধরে কপিলি ফল্ট নিয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন। তাই নীতিনির্ধারকদের উচিত ডাউকির পাশাপাশি কপিলিকেও সমান গুরুত্ব দেওয়া।

ভৌগোলিকভাবে সিলেটের দক্ষিণ প্রান্তে ডাউকি ফল্ট এবং উত্তর-পূর্বে ভুটান সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত কপিলি ফল্ট দুটিই সিলেটের কাছাকাছি অবস্থিত। ফলে এদের যে কোনো একটিতে শক্তিশালী ভূমিকম্প হলে সিলেট নগরী ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।

সিলেট সিটি করপোরেশন-সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২১ ও ২২ সালে কয়েক দফায় ভূমিকম্পের পর ঝুঁকি মোকাবিলায় কিছু উদ্যোগ নিয়েছিল সিলেট সিটি করপোরেশন। ভূমিকম্পের ক্ষতি কমাতে ২০২১ সালের মে মাসে ঝুঁকিপূর্ণ ছয়টি বিপণিবিতান বন্ধ করে দেয় সিটি করপোরেশন। এগুলো ভেঙে ফেলা হবে বলেও সে সময় জানানো হয়েছিল। তবে ভেঙে তো ফেলা হয়নিই, উল্টো কিছুদিন বন্ধ থাকার পর ফের খুলেছে ঝুঁকিপূর্ণ বিপণিবিতানগুলো।

এদিকে, সিলেটের ৪২ হাজার বহুতল ভবনের ভূমিকম্পের সহনীয়তা পরীক্ষার উদ্যোগও আটকে আছে। সিটি কর্মকর্তারা বলছেন, অর্থের অভাবে ভবন পরীক্ষা করানো যাচ্ছে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের মে ও জুনে পরপর ছয় দফা ভূমিকম্পের পর বড় ভূমিকম্পে ক্ষতি কমিয়ে আনতে নগরীর সব বহুতল ভবনের ভূমিকম্প সহনীয়তা পরীক্ষা ও অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো ভেঙে ফেলার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। এরপর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে নগরীর বন্দরবাজার ও জিন্দাবাজার এলাকার কিছু ভবন পরীক্ষা করা হয়।

এই বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য ছিলেন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও পুর প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. জহির বিন আলম। তিনি বলেন, ‘সিলেটের ভবনগুলো গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিতভাবে। ৭৪ দশমিক ৪ শতাংশ ভবনই ভূমিকম্পের কথা চিন্তা না করে তৈরি করা হয়েছে। ফলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলেই ৮০ শতাংশ বহুতল ভবন ভেঙে পড়তে পারে।’

তার ভাষায়, ‘সাত মাত্রার ভূমিকম্প এক প্রকার অ্যাটম বোমার মতো ধ্বংস ডেকে আনতে পারে। এমনকি ছয় মাত্রার ভূমিকম্প হলেও নগরীর পুরনো ভবনগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে আশার কথা হলো, সাম্প্রতিক সময়ে যেসব নতুন ভবন নির্মিত হচ্ছে, সেগুলো ভূমিকম্প প্রতিরোধী কাঠামোয় তৈরি হচ্ছে বলে ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম।’

এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘দু-চারটি ভবন নয়, বরং নগরীর সব ভবন একসঙ্গে পরীক্ষা করাতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ সব ভবন ভেঙে না ফেলে রেকটিফাইটিংও করা যেতে পারে। সাপোর্টিং পাওয়ার দিয়ে ভূমিকম্প প্রতিরোধক হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে।’

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ হুমায়ুন আখতার বলেন, ‘আমরা গবেষণায় দেখেছি যে, বাংলাদেশের ভূমিকম্পের দু’টি উৎস আছে। একটি উত্তরের দিকে, আরেকটা হচ্ছে পূর্ব দিকে। উত্তরের দিকটা হলো- ডাউকি ফল্ট (ডাউকি চ্যুতি)। এবার যে ভূমিকম্প হলো, সেই হিমালয়ন মেইন ফ্রন্টাল থ্রাস্ট বেল্টে। সেটা আমাদের ভূমিকম্পের আরেকটি উৎসস্থল ডাউকি ফল্টেরই কাছাকাছি।’

এ ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘সিলেট থেকে কক্সবাজার বা চট্টগ্রাম পর্যন্ত এই অংশটা খুব বিপজ্জনক। কেন না এখানে হাজার বছরের ওপরে বড় ভূমিকম্প হয়নি। অর্থাৎ যে শক্তিটা জমা হয়ে রয়েছে বা ক্রমাগত জমা হচ্ছে, গত এক হাজার বছরেও এই কেন্দ্রটা সেই শক্তিটা ছাড়েনি। আমরা গবেষণায় দেখেছি, এখানে ৮ দশমিক ২ থেকে ৯ মাত্রার শক্তিসম্পন্ন ভূমিকম্প সৃষ্টি হওয়ার মতো শক্তি জমা হয়ে আছে। এটি যে কোনো সময় আঘাত হানতে পারে।’

জানা গেছে, বিশেষজ্ঞদের পরীক্ষার পর ২০২১ সালের ৩০ মে নগরীর ২৪টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা প্রকাশ করে সিটি কর্তৃপক্ষ। ওই দিনই নগরীর সুরমা মার্কেট, সিটি সুপার মার্কেট, মধুবন সুপার মার্কেট, সমবায় মার্কেট, মিতালী ম্যানশন ও রাজা ম্যানশন নামের সাতটি বিপণিবিতানকে ১০ দিন বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। একই সময়ে নগরের প্রায় ৪২ হাজার বহুতল ভবন পরীক্ষার উদ্যোগ নেয় সিটি করপোরেশন। কিন্তু কোনো উদ্যোগই আর আগায়নি। তালিকায় থাকা ২৪টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের মধ্যে সংস্কারের মাধ্যমে ছয়টি ঝুঁকিমুক্তও করা হয়। কিন্তু এ প্রক্রিয়া আর এগোয়নি। এখনো ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে ১৮টি ভবন।

সিটি করপোরেশন কর্মকর্তাদের বলেছেন, ‘নগরীর অতিঝুঁকিপূর্ণ ১০টি ভবন বন্ধ করার নির্দেশনা দিয়ে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে এগুলো সংস্কার করতে বলা হয়। কিন্তু মালিকপক্ষ তা শোনেননি। এ ভবনগুলো ভাঙার উদ্যোগ নিলে গেলে তারা আদালতে মামলা ঠুকে দেন। এমতাবস্থায় আর এগোনো যায়নি।’

যদিও নগরীর ঝুঁকিপূর্ণ ভবন সংস্কার কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছেন, সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রেজাই রাফিন সরকার। কিন্তু কিভাবে, কোথায় এ কার্যক্রম চলমান রয়েছে- তা বলতে পারেননি তিনি।

সিটি করপোরেশনের এক কর্মকর্তা জানান, নগরীর ৪২ হাজার ভবনে ভূমিকম্পের সহনীয়তা নিয়ে প্রকৌশলগত বিস্তারিত মূল্যায়নের উদ্যোগ নিয়েছিল সিলেট সিটি করপোরেশন। এ জন্য ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলাপও হয়। ওই প্রতিষ্ঠানটি চারতলা একটি ভবন মূল্যায়নের জন্য ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা ফি চায়। সেই হিসেবে সব মিলিয়ে নগরীর ৪০-৪২ হাজার ভবন পরীক্ষা করাতে ২৫-৩০ কোটি টাকার প্রয়োজন। কিন্তু সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে এই খাতে এত বিশাল অঙ্কের টাকা খরচ করার মতো তহবিল নেই। তাই এখনো এ ব্যাপারে কোনো চুক্তি করা সম্ভব হয়নি। ভূমিকম্প সহনীয়তা পরীক্ষার উদ্যোগ তখনই মাঝপথেই আটকে যায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘ভূমিকম্পপ্রবণ সিলেটে শুধু ডাউকি নয়, কপিলি ফল্টকেও সমান গুরুত্ব দিয়ে গবেষণা, ঝুঁকি মূল্যায়ন ও প্রস্তুতি নিতে হবে। একই সঙ্গে পুরোনো ভবনের সংস্কার, নতুন ভবনে ভূমিকম্প প্রতিরোধী নকশা বাধ্যতামূলক করা এবং জরুরি উদ্ধার সক্ষমতা বাড়ানো ছাড়া বড় ধরনের বিপর্যয় থেকে সিলেটবাসীকে রক্ষা করা সম্ভব নয়।’

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সিলেট সিটি করপোরেশনের বর্তমান আয়তন ৭৯ দশমিক ৫ বর্গকিলোমিটার। ২০২১ সালে সীমানা বর্ধিত করার পূর্ব পর্যন্ত আয়তন ছিল ২৬ দশমিক ৫ বর্গকিলোমিটার। পূর্বের আয়তনের তালিকাভুক্ত হোল্ডিংয়ের সংখ্যা প্রায় ৭৪ হাজার। এর মধ্যে দুই থেকে ২১তলা পর্যন্ত ভবন রয়েছে ৪১ হাজার ৯৯৫টি। সীমানা বাড়ানোর পর ভবনের সংখ্যা আর জরিপ করা হয়নি।

নিউজটি শেয়ার করুন
ট্যাগসঃ

বিস্তারিত লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষণ করুন