সুদানে শহীদ ছয় শান্তিরক্ষী বিশ্বশান্তিতে বাংলাদেশের গৌরব

- আপডেট সময়ঃ ০৭:৪৮:১৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৫
- / ৫০ বার পড়া হয়েছে।

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের ইতিহাসে বাংলাদেশ এক অবিস্মরণীয় নাম। বিশ্বের সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে স্থিতিশীলতা আনা, পুনর্গঠন এবং মানবিক সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা এক অপরিহার্য শক্তিতে পরিণত হয়েছেন। বৈশ্বিক রাজনীতির টানাপড়েন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং প্রতিকূল জলবায়ু উপেক্ষা করে লাল-সবুজের পতাকাবাহীরা যে বীরত্ব দেখাচ্ছেন, তা আমাদের জাতীয় ভাবমূর্তির শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞাপন। তবে এই মর্যাদা অর্জনের পথটি রক্তে ভেজা; এ এক চরম আত্মত্যাগ ও বীরত্বের মহাকাব্য।
২০ ডিসেম্বর ২০২৫ একটি অশ্রুসিক্ত দিন হিসেবে আমাদের ইতিহাসে যুক্ত হলো, কারণ সুদানের তপ্ত মরুভূমিতে শাহাদৎবরণকারী আমাদের ছয় জন বীর সন্তানের নিথর দেহ গতকাল রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ফিরে এসেছে প্রিয় মাতৃভূমির মাটিতে। এই শহিদদের কফিনগুলো কেবল শোকের প্রতীক নয়, বরং তা আমাদের জাতীয় অহংকার। ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, শনিবার বিকালের সেই বিষাদময় মুহূর্তটি আবারও প্রমাণ করল যে, বিশ্বশান্তির জন্য বাংলাদেশ তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের উৎসর্গ করতে দ্বিধাবোধ করে না। সুদানের অ্যাবেই এলাকায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের (UNISFA) আওতাধীন কাদুগলি লজিস্টিক বেসে এক কাপুরুষোচিত ড্রোন হামলা চালায় একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠী। আকস্মিক হামলায় দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় শাহাদৎবরণ করেন বাংলাদেশের ছয় জন অকুতোভয় শান্তিরক্ষী। এই নৃশংস হামলায় আরো আট জন শান্তিরক্ষী আহত হয়েছেন। ২০ ডিসেম্বর এই বীরদের মরদেহ ঢাকায় পৌঁছানোর পর পুরো জাতি তাদের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করছে।
১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রম শুরু হলেও এই গৌরবের মঞ্চে বাংলাদেশের অভিষেক ঘটে ১৯৮৮ সালে। ইরান-ইরাক সামরিক পর্যবেক্ষক মিশনে মাত্র ১৫ জন সদস্য পাঠানোর মধ্য দিয়ে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, আজ তা মহিরুহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের ১১৯টি দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ দীর্ঘ দিন ধরে শীর্ষস্থান ও মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান ধরে রেখেছে। বর্তমানে বিশ্বের ১০টি দেশে ‘নীল হেলমেট’ মাথায় দিয়ে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা শান্তির পতাকা বহন করছেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কেবল দায়িত্ব পালন করেনি, বরং বহুবার খাদের কিনারা থেকে মানবতাকে রক্ষা করেছে। ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডায় যখন গণহত্যার ভয়াবহতায় তখন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা হালকা অস্ত্র নিয়ে অকুতোভয় বীরত্বে গণহত্যা রুখে দিয়েছিল। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা কেবল অস্ত্রধারী সৈন্য নন, তারা মানবতার দূত। কঙ্গো, সুদান, মালি ও দক্ষিণ সুদানে তারা স্কুল, হাসপাতাল, রাস্তাঘাট নির্মাণ এবং কৃষি উন্নয়নে সরাসরি ভূমিকা রাখছেন। বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের মানবিক আচরণের কারণেই পশ্চিম আফ্রিকার দেশ সিয়েরা লিওন ‘বাংলা’ ভাষাকে তাদের অন্যতম শ্রদ্ধার ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, যা বিশ্বমঞ্চে আমাদের ভাষার এক অনন্য বিজয়। এমনকি মুসলিম প্রধান দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম ২০১০ সালে শান্তিরক্ষা মিশনে নারী পুলিশের দল পাঠিয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। এ পর্যন্ত ১ হাজার ৭১৮ জন নারী শান্তিরক্ষী বিভিন্ন মিশনে অংশ নিয়েছেন। জাতিসংঘ যেখানে নারী শান্তিরক্ষীর হার ২২ শতাংশ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, বাংলাদেশ ইতিমধ্যে ১৮-১৯ শতাংশ নিশ্চিত করেছে।
শান্তির এই পথ অত্যন্ত কণ্টকাকীর্ণ। এ পর্যন্ত জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের ১৭১ জন বীর শান্তিরক্ষী (সর্বশেষ ছয় জনসহ) জীবন উৎসর্গ করেছেন। এছাড়া আহত হয়েছেন ২৭২ জন। এই বিপুল আত্মত্যাগ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। শান্তিরক্ষী মিশন কেবল আমাদের সামরিক মর্যাদা বাড়ায়নি, বরং জাতীয় অর্থনীতিতেও বিশাল অবদান রাখছে। এই খাত থেকে বার্ষিক আয় ২ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে বড় শক্তি জোগায়। জাতিসংঘ বাংলাদেশের এই ভূমিকাকে ‘শান্তির কূটনীতির মোরসাল’ হিসেবে অভিহিত করেছে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে এখন আরো বেশি শক্ত অবস্থানে। ডিআর কঙ্গোতে সেনাবাহিনীর তিনটি হেলিকপটার মোতায়েন করা আমাদের সক্ষমতার নতুন স্মারক। ২০ ডিসেম্বর ঢাকায় ফেরা আমাদের শহিদদের কফিনগুলো এই বার্তা দেয় যে, বিশ্বশান্তির জন্য বাংলাদেশ কতটা চড়া মূল্য দিতে প্রস্তুত। শহিদের রক্তে ভেজা এই গৌরবগাথা কেবল সেনাবাহিনীর নয়, বরং সমগ্র বাংলাদেশের এক অবিনশ্বর অহংকার। বিশ্বের সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে স্থিতিশীলতা আনা, পুনর্গঠন এবং মানবিক সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা আজ এক অপরিহার্য নাম। বৈশ্বিক রাজনীতির টানাপড়েন উপেক্ষা করে লাল-সবুজের পতাকাবাহীরা যে বীরত্ব দেখাচ্ছেন, তা আমাদের জাতীয় ভাবমূর্তির শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞাপন হিসেবে অম্লান হয়ে থাকবে। সূত্র: ইত্তেফাক


















