০৭:৫৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৫

কুরবানির ইতিহাস ও তাৎপর্য

স্টাফ রিপোর্টার
  • আপডেট সময়ঃ ০৫:৪৯:০৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ২ জুন ২০২৫
  • / ১২৮ বার পড়া হয়েছে।

কুরবানি ইসলামের অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ ইবাদত। এটি শুধু পশু জবাইয়ের একটি আচারিক দিক নয়, বরং এটি মুসলমানদের জন্য এক মহান আত্মত্যাগ, আনুগত্য, মানবিকতা ও তাকওয়ার চেতনা বহন করে। হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর অতুলনীয় আত্মত্যাগের ঘটনা মুসলিম সমাজে এমন এক উদাহরণ হয়ে আছে যা শুধু ইতিহাসের স্মৃতি নয়, বরং একটি চিরন্তন শিক্ষার বাহক। এ প্রবন্ধে কুরবানির ঐতিহাসিক পটভূমি, শরিয়তের দৃষ্টিকোণ, ফিকহি বিধান, আধ্যাত্মিক তাৎপর্য এবং সমসাময়িক প্রাসঙ্গিকতা বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

কুরবানির শাব্দিক ও পরিভাষাগত অর্থ : ‘কুরবানি’ শব্দটি আরবি ‘কুরবান’-এর বাংলা রূপ। এর অর্থ হলো আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের উদ্দেশ্যে কিছু উৎসর্গ করা। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায়, নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট পশু আল্লাহর উদ্দেশ্যে জবাই করাকে কুরবানি বলা হয়। কুরআনে এসেছে : ‘তোমাদের কুরবানির পশুর গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, বরং পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।’ (সূরা হজ : ৩৭)।

কুরবানির প্রাচীন ইতিহাস : নবুয়ত যুগ থেকে শুরু। হজরত আদম (আ.)-এর যুগে কুরবানি। ইসলামি ইতিহাস মতে, কুরবানির প্রথম দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় হজরত আদম (আ.)-এর দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের ঘটনা থেকে। তারা উভয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কুরবানি করেন। কিন্তু আল্লাহ হাবিলের কুরবানি গ্রহণ করেন এবং কাবিলেরটি প্রত্যাখ্যান করেন। এ থেকেই বোঝা যায়, কুরবানির গ্রহণহণযোগ্যতা নির্ভর করে নিয়তের ওপর। ইবরাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.)-এর আত্মত্যাগ; হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর ঘটনা ইসলামি কুরবানির মূল ভিত্তি। আল্লাহ তাকে নির্দেশ দেন প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আ.) কে কুরবানি করতে। এ আদেশ পালন করতে তিনি প্রস্তুত হন এবং তার পুত্রও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আত্মত্যাগে রাজি হন। তাদের পরীক্ষার পূর্ণতা পাওয়ার পর আল্লাহ ইসমাইল (আ.)-এর পরিবর্তে একটি দুম্বা পাঠিয়ে বলেন : ‘নিঃসন্দেহে এটা ছিল এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা, এবং আমি তার পরিবর্তে এক মহান কুরবানি দান করলাম।’ (সুরা আস-সাফফাত : ১০৬-১০৭)।

কুরবানি মূলত ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা। আত্মা, ইচ্ছা ও লালসার ওপর বিজয় লাভই এখানকার মূল লক্ষ্য। পশু জবাই করা হলেও প্রকৃত কুরবানি হলো নিজের ‘নফস’-এর নিয়ন্ত্রণ। আত্মত্যাগের শিক্ষা : ইবরাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.) আমাদের শিখিয়েছেন, আল্লাহর নির্দেশের সামনে পিতা-পুত্রের সম্পর্ক, আবেগ বা সম্পদ-কোনো কিছুই বড় নয়। এটি ইমানদারদের জন্য চরম আত্মসমর্পণের পাঠ। সামাজিক সাম্য ও সহমর্মিতা।

ইসলামি শরিয়তে কুরবানির বিধান : কুরআন ও হাদিসের আলোকে; অর্থাৎ‘তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ো এবং কুরবানি করো।’ (সুরা কাউসার : ২)। হাদিস :  রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আশুরার দিন কেউ যদি কুরবানি করতে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও তা না করে, তাহলে সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩১২৩)।

চার মাজহাবের অবস্থান : হানাফি মাজহাব : সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্য কুরবানি ওয়াজিব। মালিকি, শাফেয়ি ও হাম্বলি মাজহাব : এটি সুন্নাতে মু’আক্কাদা। কুরবানির সময়সীমা : কুরবানি দেওয়া যায় ১০ জিলহজ ঈদের নামাজের পর থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত। শহরের বাসিন্দার জন্য ঈদ নামাজের পূর্বে কুরবানি বৈধ নয়। কুরবানির পশু : শর্ত ও বিধান; কুরবানিযোগ্য পশু : উট : ৫ বছর পূর্ণ। গরু/মহিষ : ২ বছর পূর্ণ। ছাগল/ভেড়া : ১ বছর পূর্ণ (বা ৬ মাসে বড় আকৃতির হলে জায়েজ)।

শরিক হওয়ার বিধান : একটি উট বা গরুতে সর্বোচ্চ সাতজন শরিক হতে পারেন। ছাগল বা ভেড়ায় কেবল একজন। অযোগ্য পশুর বৈশিষ্ট্য : কুরবানির জন্য নিচের ধরনের পশু অযোগ্য : অন্ধ বা এক চোখে অন্ধ, খোঁড়া যেটি স্পষ্টভাবে চলতে পারে না, অতিরিক্ত রুগ্ণ বা হাড় বেরিয়ে গেছে। কুরবানির পরিপূর্ণতা : পশুকে দয়া ও সহানুভূতির সঙ্গে জবাই করতে হবে। ধারালো ছুরি ব্যবহার করা সুন্নাত। পশুকে অন্য পশুর সামনে জবাই না করাই উত্তম।

কুরবানির মাংস বণ্টন : শরিয়তের নির্দেশনা; সুন্নাহ অনুযায়ী মাংস তিন ভাগে ভাগ করা উত্তম : ১. নিজ পরিবার, ২. আত্মীয় ও বন্ধুবান্ধব, ৩. গরিব-দুঃখী ও মিসকিন। যাহোক, কেউ চাইলে পুরোটাই দান করতে পারেন। কেউ নিজের জন্য রেখে সবও খেতে পারেন (হানাফি মত)। তবে দান করা উত্তম।

কুরবানির আধ্যাত্মিক তাৎপর্য ও দর্শন : তাকওয়া অর্জনের মাধ্যম : কুরবানি মূলত ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা। আত্মা, ইচ্ছা ও লালসার ওপর বিজয় লাভই এখানকার মূল লক্ষ্য। পশু জবাই করা হলেও প্রকৃত কুরবানি হলো নিজের ‘নফস’-এর নিয়ন্ত্রণ। আত্মত্যাগের শিক্ষা : ইবরাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.) আমাদের শিখিয়েছেন, আল্লাহর নির্দেশের সামনে পিতা-পুত্রের সম্পর্ক, আবেগ বা সম্পদ-কোনো কিছুই বড় নয়। এটি ইমানদারদের জন্য চরম আত্মসমর্পণের পাঠ। সামাজিক সাম্য ও সহমর্মিতা। মাংস বণ্টনের মাধ্যমে সমাজের গরিব, মিসকিন ও অসহায়দের মুখে হাসি ফোটানো হয়। এটা ইসলামের মানবিক, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের চেতনা বহন করে।

সমসাময়িক দৃষ্টিকোণ : আধুনিক যুগে কুরবানির প্রাসঙ্গিকতা : ১. কুরবানির বিরুদ্ধে প্রচলিত অভিযোগ : পশু জবাইকে অনেক আধুনিক ‘অ্যানিমাল রাইটস’ কর্মী নিষ্ঠুরতা বলে থাকেন। কিন্তু ইসলাম স্পষ্টভাবে দয়া ও সংবেদনশীলতার সঙ্গে পশু জবাই করতে বলে। রাসুল (সা.) বলেন : ‘তোমরা যখন পশু জবাই করো, তখন তা ভালোভাবে করো। ছুরি ধারালো করো এবং পশুকে কষ্ট দিও না।’ (সহিহ মুসলিম)। ২. আধুনিক কুরবানি ব্যবস্থা : বর্তমানে অনলাইন কুরবানি, এনজিও ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন সংস্থা আন্তর্জাতিকভাবে কুরবানি করে থাকেন, যেখানে সুবিধাবঞ্চিত অঞ্চলে মাংস বিতরণ করা হয়। এটি কুরবানির একটি বিস্তৃত সামাজিক রূপ।

কুরবানির মনস্তত্ত্ব ও নৈতিক শিক্ষা : আত্মসংযম ও ইচ্ছার নিয়ন্ত্রণ : কুরবানির পূর্বে পশুর প্রতি মায়া, ভালোবাসা তৈরি হয়, কিন্তু তাকওয়ার জন্য ত্যাগ করা শিখায়, যা জীবনের জন্য গভীর শিক্ষা। আনুগত্য ও আত্মনিবেদন : জীবন ও সম্পদ-সবকিছুই আল্লাহর জন্য উৎসর্গের মনোভাব তৈরি হয়। ভোগবাদী সমাজে ত্যাগের শিক্ষা : যেখানে ভোগ ও আত্মকেন্দ্রিকতা প্রাধান্য পায়, সেখানে কুরবানি মানুষের আত্মিক পরিশুদ্ধির সুযোগ দেয়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কুরবানির গুরুত্ব : বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কুরবানির গুরুত্ব আলাদা মাত্রা বহন করে। এটি শুধু একটি ধর্মীয় আচার নয়, বরং অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানবিক দিক থেকেও এর বিশাল প্রভাব রয়েছে। নিচে বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে কুরবানির বহুমাত্রিক গুরুত্ব তুলে ধরা হলো : ১. ধর্মীয় গুরুত্ব : বাংলাদেশ একটি মুসলিম প্রধান দেশ, যেখানে প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ ইসলামের অনুসারী। কুরবানি ঈদ (ঈদুল আজহা) বছরে সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসবগুলোর একটি, যা আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ইবাদতের মাধ্যমে পালন করা হয়। প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলমান এ ইবাদতের মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন ও ইবরাহিমি আত্মত্যাগের শিক্ষা ধারণ করেন। ২. অর্থনৈতিক গুরুত্ব : বাংলাদেশে কুরবানির সময় একটি বিশাল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সৃষ্টি হয়, যা দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। গবাদিপশু খাত; কুরবানিকে কেন্দ্র করে গবাদিপশু পালনকারী কৃষক ও খামারিরা বছরে একবার বড় রকমের আয় করেন।

দেশে প্রায় ১ কোটি গরু-ছাগল পালন হয় কুরবানিকে কেন্দ্র করে, যা কৃষি খাতকে চাঙ্গা রাখে। পশুর হাট ও লেনদেন : ঈদের আগে সারা দেশে শত শত কুরবানির পশুর হাট বসে। ২০২৩ সালে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়েছিল কুরবানির পশু বিক্রি করে (সূত্র : বাংলাদেশ ব্যাংক)। কর্মসংস্থান সৃষ্টি; পশু পালন, হাট ব্যবস্থাপনা, পরিবহণ, কসাই, চামড়া প্রক্রিয়াকরণ, প্যাকেটিংসহ বহু খাতের মানুষ এই সময় সাময়িক বা মৌসুমি কাজ পান। ৩. সামাজিক ও মানবিক গুরুত্ব : দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা : কুরবানির মাংস সমাজের গরিব-দুঃখীদের মাঝে পৌঁছে যায়। দেশের প্রত্যন্ত গ্রহণামাঞ্চলেও বহু দরিদ্র মানুষ বছরের একমাত্র সময় হিসেবে গোশত খাওয়ার সুযোগ পান। সহমর্মিতা ও সাম্য প্রতিষ্ঠা; ধনী-গরিবের মাঝে ভেদাভেদ দূর হয়, ইসলামের সমাজতান্ত্রিক চেতনা পরিপূর্ণরূপে প্রতিফলিত হয়। কুরবানির মাধ্যমে একে অপরের সাথে সম্প্রীতির বন্ধন গড়ে ওঠে।

উপসংহার : কুরবানি একটি ইবাদত যা আমাদের শুধু ধর্মীয়ভাবে নয়, মানসিক, নৈতিক, সামাজিক ও আত্মিকভাবে গঠন করে। ইবরাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.)-এর আত্মত্যাগ ইসলামের চিরন্তন চেতনা-আনুগত্য ও তাকওয়ার প্রতীক। কুরবানি আমাদের শেখায়, জীবন শুধুই ভোগের জন্য নয়, বরং আল্লাহর আদেশ পালনের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির একটি পথ। সমসাময়িক বিশ্বে যখন ভোগ, বৈষয়িকতা ও আত্মকেন্দ্রিকতা বাড়ছে, তখন কুরবানির এ চেতনা মানুষের মাঝে মানবতা, সহানুভূতি ও আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করে।

নিউজটি শেয়ার করুন
ট্যাগসঃ

বিস্তারিত লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষণ করুন

আপলোডকারীর তথ্য