০৪:৫৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ অগাস্ট ২০২৫

২৮ বছর ধরে নিজের টাকায় গাছ লাগান শ্রীমঙ্গলের বিষ্ণু

অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট সময়ঃ ০৭:৩৯:১৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১২ অগাস্ট ২০২৫
  • / ৩৬ বার পড়া হয়েছে।

সময়–সুযোগ পেলেই নিজের বাইসাইকেলের পেছনে চারা ও গাছ লাগানোর সরঞ্জাম নিয়ে এখানে-সেখানে ছোটেন বিষ্ণু হাজরা (৪০)। রাস্তার ধার, ফাঁকা মাঠ, চা–বাগানের আনাচকানাচে রোপণ করেন নানা ধরনের গাছ। এতেই তাঁর আনন্দ। এ কাজে নিজের পকেট থেকে টাকা খরচ করতে দ্বিধাবোধ করেন না তিনি। চা–শ্রমিক পরিবারে জন্ম নেওয়া মানুষটি দারিদ্র্য উপেক্ষা করে বেছে নিয়েছেন পরিবেশ রক্ষার কাজ। ১৯৯৭ সাল থেকে তিনি এ কাজ করে আসছেন।

বিষ্ণু হাজরা মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়া চা–বাগানের বাসিন্দা। তিনি পেশায় চা–শ্রমিক। চা–বাগানে কাজের পাশাপাশি সেখানে ঝালমুড়িও বিক্রি করেন। তাঁর পরিবারে মা-বাবা, স্ত্রী ও দুই ছেলে রয়েছে।

সম্প্রতি এক দুপুরে ভাড়াউড়া চা–বাগানের দুর্গামন্দির প্রাঙ্গণে বিষ্ণুর সঙ্গে দেখা হয়। কয়েকজন তরুণ-যুবককে নিয়ে মন্দিরটির চারপাশে ছোট ছোট গর্ত করছিলেন তিনি। একপর্যায়ে সেখানে রোপণ করছেন জাম, নিম, বট আর কাঠগোলাপের চারা।

আলাপকালে বিষ্ণু বলেন, ‘১৯৯৪ সালে ষষ্ঠ শ্রেণিতে শহরের ভিক্টোরিয়া উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হই। আমাদের চা–শ্রমিক পরিবারে অভাব–অনটন লেগেই থাকত। তখন পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনিও করতাম। একদিন মাথায় এলো—যদি কিছু গাছের চারা লাগাই, সেই চারা বড় হলে অনেক টাকায় বেচতে পারব, অর্থকষ্ট কমবে। ১৯৯৭ সালে আমি নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বৃক্ষ’ কবিতাটি পড়ি। সেই কবিতা থেকে বেশ অনুপ্রাণিত হই, গাছের অনেক উপকারিতার কথা জানতে পারি। তখন থেকে টিউশনির টাকার একটি অংশ দিয়ে টুকটাক গাছ লাগানো শুরু করি।’

গাছ লাগানোর পর সেগুলোর পরিচর্যার কাজও বিষ্ণু নিজে করেন। কারও জন্মদিন, মৃত্যুবার্ষিকী, বিয়ে বা কোনো অনুষ্ঠানে তিনি গাছের চারা উপহার দেন। তাঁর মনে গাছ ও পরিবেশের প্রতি ভালোবাসার বিষয়টি আরও পাকাপোক্ত হয় ২০১৪ সালের পর থেকে। ওই সময় থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিনি পত্রিকার হকার ছিলেন। তখন পত্রিকাগুলোর বিভিন্ন লেখা পড়তেন। পরিবেশ নিয়ে লেখাগুলো বিশেষভাবে মনোযোগ দিয়ে পড়তেন।

বিষ্ণুর ভাষ্য, ‘ফেসবুকে বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যার ছবি-ভিডিও দিয়ে অন্যদেরও গাছ লাগানোর জন্য অনুপ্রাণিত করি এখন। আমার গাছ লাগানো কার্যক্রম অনেক আগে থেকে হলেও ২০২০ সাল থেকে পুরোদমে গাছ লাগানোর কাজ শুরু করি। তখন ফেসবুকে আমার কার্যক্রম দেখে অনেকে আমার সঙ্গে যোগ দেন। অনেকেই আমাকে গাছের চারা কিনে দিয়ে সহযোগিতা করছেন। আমি উপার্জনের একটি অংশ গাছ লাগানোর জন্য ব্যয় করছি।’

বিষ্ণুর মতে, অবাধে বৃক্ষনিধন, বন-জঙ্গল উজাড়, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, অপরিকল্পিত ময়লার ভাগাড়, প্লাস্টিক দূষণ, নদী দখল ও দূষণ আমাদের পরিবেশ নষ্ট করছে। এসব রক্ষায় বৃক্ষরোপণের বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণও করতে হবে।

বিষ্ণুর কাজের প্রশংসা করে ‘স্ট্যান্ড ফর আওয়ার এনডেঞ্জার্ড ওয়াইল্ডলাইফ’ টিমের সদস্য ও ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার কাজল হাজরা বলেন, ‘নিজের টাকা খরচ করে প্রায়ই বিষ্ণু গাছের চারা রোপণ করে বেড়ান। অনেক আগে থেকেই তাঁকে এই কাজ করতে দেখছি। গাছ লাগিয়ে তিনি অনেক আনন্দ পান। অনেক অনুষ্ঠানে তিনি গাছ উপহার দেন। আমাদের সবার উচিত বিষ্ণুর মতো বৃক্ষরোপণে এগিয়ে আসা।’

ভাড়াউড়া চা–বাগানের সাবেক সরদার লচমী রবিদাস বলেন, বিষ্ণু মানুষের উপকার করা নিয়েই থাকেন। স্কুলে পড়ার সময় তার বয়সী ছেলেরা যখন খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত থাকত, তখন তিনি গাছ লাগানোর কাজ করতেন। যখনই তাঁর সঙ্গে দেখা হয়, চারা হাতে কোথাও না কোথাও তাঁকে যেতে দেখা যায়।

বিষ্ণুর কাজের জন্য গর্বিত তাঁর বাবা প্রেমলাল হাজরা। তিনি বলেন, অনেকের অনেক শখ থাকে, বিষ্ণুর শখ গাছ লাগানো। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই বিষ্ণু তাঁর কাছ থেকে টাকা নিয়ে গাছ কিনত। এখন অনেকেই তাঁকে বলেন, তোমার ছেলে পরিবেশ রক্ষায় কাজ করছে। এ কথা শুনে তাঁর শান্তি লাগে।

নিউজটি শেয়ার করুন
ট্যাগসঃ

বিস্তারিত লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষণ করুন

২৮ বছর ধরে নিজের টাকায় গাছ লাগান শ্রীমঙ্গলের বিষ্ণু

আপডেট সময়ঃ ০৭:৩৯:১৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১২ অগাস্ট ২০২৫

সময়–সুযোগ পেলেই নিজের বাইসাইকেলের পেছনে চারা ও গাছ লাগানোর সরঞ্জাম নিয়ে এখানে-সেখানে ছোটেন বিষ্ণু হাজরা (৪০)। রাস্তার ধার, ফাঁকা মাঠ, চা–বাগানের আনাচকানাচে রোপণ করেন নানা ধরনের গাছ। এতেই তাঁর আনন্দ। এ কাজে নিজের পকেট থেকে টাকা খরচ করতে দ্বিধাবোধ করেন না তিনি। চা–শ্রমিক পরিবারে জন্ম নেওয়া মানুষটি দারিদ্র্য উপেক্ষা করে বেছে নিয়েছেন পরিবেশ রক্ষার কাজ। ১৯৯৭ সাল থেকে তিনি এ কাজ করে আসছেন।

বিষ্ণু হাজরা মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়া চা–বাগানের বাসিন্দা। তিনি পেশায় চা–শ্রমিক। চা–বাগানে কাজের পাশাপাশি সেখানে ঝালমুড়িও বিক্রি করেন। তাঁর পরিবারে মা-বাবা, স্ত্রী ও দুই ছেলে রয়েছে।

সম্প্রতি এক দুপুরে ভাড়াউড়া চা–বাগানের দুর্গামন্দির প্রাঙ্গণে বিষ্ণুর সঙ্গে দেখা হয়। কয়েকজন তরুণ-যুবককে নিয়ে মন্দিরটির চারপাশে ছোট ছোট গর্ত করছিলেন তিনি। একপর্যায়ে সেখানে রোপণ করছেন জাম, নিম, বট আর কাঠগোলাপের চারা।

আলাপকালে বিষ্ণু বলেন, ‘১৯৯৪ সালে ষষ্ঠ শ্রেণিতে শহরের ভিক্টোরিয়া উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হই। আমাদের চা–শ্রমিক পরিবারে অভাব–অনটন লেগেই থাকত। তখন পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনিও করতাম। একদিন মাথায় এলো—যদি কিছু গাছের চারা লাগাই, সেই চারা বড় হলে অনেক টাকায় বেচতে পারব, অর্থকষ্ট কমবে। ১৯৯৭ সালে আমি নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বৃক্ষ’ কবিতাটি পড়ি। সেই কবিতা থেকে বেশ অনুপ্রাণিত হই, গাছের অনেক উপকারিতার কথা জানতে পারি। তখন থেকে টিউশনির টাকার একটি অংশ দিয়ে টুকটাক গাছ লাগানো শুরু করি।’

গাছ লাগানোর পর সেগুলোর পরিচর্যার কাজও বিষ্ণু নিজে করেন। কারও জন্মদিন, মৃত্যুবার্ষিকী, বিয়ে বা কোনো অনুষ্ঠানে তিনি গাছের চারা উপহার দেন। তাঁর মনে গাছ ও পরিবেশের প্রতি ভালোবাসার বিষয়টি আরও পাকাপোক্ত হয় ২০১৪ সালের পর থেকে। ওই সময় থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিনি পত্রিকার হকার ছিলেন। তখন পত্রিকাগুলোর বিভিন্ন লেখা পড়তেন। পরিবেশ নিয়ে লেখাগুলো বিশেষভাবে মনোযোগ দিয়ে পড়তেন।

বিষ্ণুর ভাষ্য, ‘ফেসবুকে বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যার ছবি-ভিডিও দিয়ে অন্যদেরও গাছ লাগানোর জন্য অনুপ্রাণিত করি এখন। আমার গাছ লাগানো কার্যক্রম অনেক আগে থেকে হলেও ২০২০ সাল থেকে পুরোদমে গাছ লাগানোর কাজ শুরু করি। তখন ফেসবুকে আমার কার্যক্রম দেখে অনেকে আমার সঙ্গে যোগ দেন। অনেকেই আমাকে গাছের চারা কিনে দিয়ে সহযোগিতা করছেন। আমি উপার্জনের একটি অংশ গাছ লাগানোর জন্য ব্যয় করছি।’

বিষ্ণুর মতে, অবাধে বৃক্ষনিধন, বন-জঙ্গল উজাড়, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, অপরিকল্পিত ময়লার ভাগাড়, প্লাস্টিক দূষণ, নদী দখল ও দূষণ আমাদের পরিবেশ নষ্ট করছে। এসব রক্ষায় বৃক্ষরোপণের বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণও করতে হবে।

বিষ্ণুর কাজের প্রশংসা করে ‘স্ট্যান্ড ফর আওয়ার এনডেঞ্জার্ড ওয়াইল্ডলাইফ’ টিমের সদস্য ও ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার কাজল হাজরা বলেন, ‘নিজের টাকা খরচ করে প্রায়ই বিষ্ণু গাছের চারা রোপণ করে বেড়ান। অনেক আগে থেকেই তাঁকে এই কাজ করতে দেখছি। গাছ লাগিয়ে তিনি অনেক আনন্দ পান। অনেক অনুষ্ঠানে তিনি গাছ উপহার দেন। আমাদের সবার উচিত বিষ্ণুর মতো বৃক্ষরোপণে এগিয়ে আসা।’

ভাড়াউড়া চা–বাগানের সাবেক সরদার লচমী রবিদাস বলেন, বিষ্ণু মানুষের উপকার করা নিয়েই থাকেন। স্কুলে পড়ার সময় তার বয়সী ছেলেরা যখন খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত থাকত, তখন তিনি গাছ লাগানোর কাজ করতেন। যখনই তাঁর সঙ্গে দেখা হয়, চারা হাতে কোথাও না কোথাও তাঁকে যেতে দেখা যায়।

বিষ্ণুর কাজের জন্য গর্বিত তাঁর বাবা প্রেমলাল হাজরা। তিনি বলেন, অনেকের অনেক শখ থাকে, বিষ্ণুর শখ গাছ লাগানো। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই বিষ্ণু তাঁর কাছ থেকে টাকা নিয়ে গাছ কিনত। এখন অনেকেই তাঁকে বলেন, তোমার ছেলে পরিবেশ রক্ষায় কাজ করছে। এ কথা শুনে তাঁর শান্তি লাগে।

নিউজটি শেয়ার করুন