০৪:৫২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ অগাস্ট ২০২৫

যে ভূমিতে যুগে যুগে অসংখ্য নবি-রাসুল আগমন করেন

অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট সময়ঃ ০৯:৫৬:২৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৮ অগাস্ট ২০২৫
  • / ২৫ বার পড়া হয়েছে।

ফিলিস্তিন এক পবিত্র ভূমি। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই মাটি বহন করেছে অসংখ্য নবি ও রাসুলের পদচিহ্ন। এটি হিজরতের ভূমি, মহান আল্লাহর অশেষ বরকতের ভূমি। এখানেই অবস্থিত মুসলিমদের তৃতীয় পবিত্রতম স্থান মসজিদুল আকসা।

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআনে এই মসজিদের মহিমা বর্ণনা করেছেন, ‘পবিত্র সেই সত্তা, যিনি নিজ বান্দাকে রাতারাতি মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসায় নিয়ে যান, যার চারপাশকে আমি বরকতময় করেছি।’

ফিলিস্তিন নিজের বুকে ধারণ করেছে এমন সব নবি-রাসুল, যাদের পদস্পর্শে এই মাটি ধন্য হয়েছে। মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে শেষ নবি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত বহু নবি এই পবিত্র ভূমিতে আগমন করেছেন। আজ আমরা সেসব মহান ব্যক্তিত্বের কথা জানব, যারা ফিলিস্তিনকে করেছেন মহিমান্বিত।

হজরত ইবরাহিম খলিলুল্লাহ আলাইহিস সালাম। তিনি ইরাকের বাবেল শহরে জন্ম করেন। আল্লাহর একত্ববাদের বাণী প্রচার করতে গিয়ে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিলেন তিনি। নিজ বাবার কাছ থেকে পেয়েছিলেন দেশান্তরের হুমকি। কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘হে ইবরাহিম। তুমি কি আমার উপাস্যদের থেকে বিমুখ? যদি তুমি বিরত না হও তবে অবশ্যই আমি পাথরের আঘাতে তোমার প্রাণ নাশ করব। আর তুমি চিরতরে আমাকে ত্যাগ করে চলে যাও।’ (সুরা মারইয়াম, আয়াত ৪৬)

ঈমান রক্ষার তাগিদে হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের স্ত্রী সারা ও ভাতিজা লুতকে সঙ্গে নিয়ে প্রথমে হাররান, তারপর হালব হয়ে হিজরত করেন ফিলিস্তিনের বায়তুল মুকাদ্দাসে। ফিলিস্তিনেই তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন এবং জেরুজালেমে তাকে সমাহিত করা হয়।

বায়তুল মুকাদ্দাসে হিজরতের পর দীর্ঘ ২০ বছর হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম ছিলেন নিঃসন্তান। বিবি সারার পরামর্শে তিনি দাসী হাজেরাকে বিবাহ করেন। হাজেরার গর্ভে ফিলিস্তিনে জন্ম নেন হজরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম। পরবর্তী সময়ে আল্লাহর নির্দেশে হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম শিশু ইসমাঈল ও হাজেরাকে মক্কায় রেখে আসেন।

আল্লাহতায়ালা কোরআনে বলেন, হে আমার প্রতিপালক। আমি আমার কিছু বংশধরকে আপনার সম্মানিত ঘরের আশপাশে বসবাস করিয়েছি, এমন এক উপত্যকায়, যেখানে কোনো ক্ষেত-খামার নেই। হে আমাদের প্রতিপালক। যাতে তারা নামাজ কায়েম করে। মানুষের অন্তরে তাদের প্রতি অনুরাগ সৃষ্টি করে দিন। তাদের ফলমূলের রিজিক দান করুন। যাতে তারা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে। আর হজরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম মক্কায়ই জীবন অতিবাহিত করেন এবং সেখানেই সমাহিত হন।

হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের দ্বিতীয় পুত্র হজরত ইসহাক আলাইহিস সালাম। তিনিও জন্মগ্রহণ করেন ফিলিস্তিনে। বৃদ্ধ বয়সে স্ত্রী সারার গর্ভে তার জন্মের সুসংবাদ পেয়ে হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। সব প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাকে বৃদ্ধ বয়সে ইসমাঈল ও ইসহাক দিয়েছেন। নিশ্চয় আমার প্রতিপালক অত্যধিক দোয়া শ্রবণকারী। (সুরা ইবরাহিম, আয়াত ৩৯) হজরত ইসহাক আলাইহিস সালাম বাবার সঙ্গে ফিলিস্তিনেই বসবাস করেন এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করে সমাহিত হন।

হজরত লুত আলাইহিস সালাম। তিনি এই বৃহত্তর ফিলিস্তিনের অধিবাসী ছিলেন। তিনি হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের প্রতি ঈমান এনে তার সঙ্গে ফিলিস্তিনে হিজরত করেছিলেন। পরে তিনি আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার জন্য সাদুম ও আমুরায় যান, যা বর্তমানে মৃত সাগর ও তার তীরবর্তী এলাকা হিসেবে পরিচিত। সেখানকার অধিবাসীরা ছিল অত্যন্ত নিকৃষ্ট চরিত্রের, তারা সমকামিতায় লিপ্ত ছিল।

হজরত লুত আলাইহিস সালাম তাদের এই ঘৃণিত কাজ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান। আল্লাহ কোরআনে বলেন, ‘আমি লুতকে প্রেরণ করেছি। যখন সে নিজ জাতিকে বলল, তোমরা কি এমন অশ্লীল কাজ করছ, যা তোমাদের আগে সারা বিশ্বের কেউ করেনি। তোমরা তো কামবশত নারীদের ছেড়ে পুরুষদের কাছে গমন করো। বরং তোমরা সীমালঙ্ঘন করছ।’ (সুরা আরাফ, আয়াত ৮০-৮১) তাদের পাপের কারণে আল্লাহর গজব নেমে আসে এবং হজরত লুত আলাইহিস সালাম ও তার ঈমানদার সঙ্গীরা রক্ষা পান।

হজরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম, যিনি ইসরাইল নামেও পরিচিত ছিলেন, হজরত ইসহাক আলাইহিস সালামের ছেলে এবং হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের নাতি। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ফিলিস্তিনে। ভাইয়ের সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় তিনি কিছুদিনের জন্য দক্ষিণ ইরাকের ফাদ্দান আরামে যান। সেখানে দীর্ঘ সময় অবস্থানের পর স্ত্রী-সন্তানসহ তিনি পুনরায় ফিলিস্তিনে ফিরে আসেন। হজরত ইয়াকুব আলাইহিস সালামের ১২ জন ছেলে সন্তান ছিল।

জীবনের শেষদিকে তিনি মিসরে হিজরত করেছিলেন এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। তবে মৃত্যুর আগে তিনি সন্তানদের অছিয়ত করেছিলেন, মিসর ত্যাগ করার সময় যেন তার লাশ ফিলিস্তিনে নিয়ে যাওয়া হয়। তার অছিয়ত অনুযায়ী, তার লাশ ফিলিস্তিনে আনা হয় এবং বায়তুল মুকাদ্দাসের পবিত্র ভূমিতে সমাহিত করা হয়।

হজরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম। তিনি ছিলেন হজরত ইয়াকুব আলাইহিস সালামের ছেলে। তার জীবনের ঘটনা কোরআনে ‘আহসানুল কাসাস’ অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ কাহিনি হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। তার জন্ম দক্ষিণ ইরাকের ফাদ্দান আরামে হলেও, শৈশবের কিছু সময় তিনি বাবার সঙ্গে ফিলিস্তিনেই কাটিয়েছিলেন। ছোটবেলায় ভাইয়ের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে তিনি মিসরে যান এবং পরবর্তী সময়ে নবুয়ত লাভ করে মিসরের মন্ত্রী হন। তিনি তার বাবা ও ভাইদের মিসরে নিয়ে আসেন এবং সেখানেই তার মৃত্যু হয়। তবে তার শেষ ইচ্ছানুযায়ী, তার লাশকেও ফিলিস্তিনের বায়তুল মুকাদ্দাসে স্থানান্তর করা হয়।

হজরত দাউদ আলাইহিস সালাম। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ফিলিস্তিনে এবং একই সঙ্গে ছিলেন নবি ও বাদশাহ। পাহাড়-পর্বত ও পাখিরা তার অনুগত ছিল। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি দাউদকে বিশেষভাবে অনুগ্রহ দান করেছি। হে পাহাড়-পর্বত, হে পাখিরা, তোমরাও দাউদের সঙ্গে আমার তাসবিহ পড়ো। আর আমি তার জন্য লোহাকে নরম করে দিয়েছিলাম।’ (সুরা সাবা, আয়াত ১০)

নবুয়ত লাভের আগে তিনি ফিলিস্তিনিদের পক্ষে জালুতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন এবং তাকে হত্যা করেন। তিনি আসদুদ, বাইতে দুজান, আবু গাওস, বায়তুল মুকাদ্দাস ও রামলার শাসক ছিলেন। ফিলিস্তিনেই তিনি ইন্তেকাল করেন এবং বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে রামলাগামী পথের পাশে একটি পাহাড়ে তাকে সমাহিত করা হয়।

হজরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম। তিনি ছিলেন হজরত দাউদ আলাইহিস সালামের ছেলে। তিনি ছিলেন আল্লাহর নবি এবং পৃথিবীর অন্যতম প্রভাবশালী শাসক। আল্লাহতায়ালা পশুপাখি, বায়ুমণ্ডল ও জিন জাতিকে তার অধীন করে দিয়েছিলেন। এই মহান নবির জন্ম ও জীবনযাপন ছিল ফিলিস্তিন কেন্দ্রিক। তিনি ঐতিহাসিক বায়তুল মুকাদ্দাস মসজিদের নির্মাতা। খ্রিষ্টপূর্ব ৯২৩ সালে ফিলিস্তিনেই তিনি ইন্তেকাল করেন এবং বায়তুল মুকাদ্দাসে তাকে দাফন করা হয়।

আল্লাহর আরেক নবি হজরত ইয়াহইয়া আলাইহিস সালাম। তিনিও ফিলিস্তিনের বায়তুল মুকাদ্দাসে জন্মগ্রহণ করেন। হজরত জাকারিয়া আলাইহিস সালামের দোয়ায় বৃদ্ধ বয়সে আল্লাহ তাকে দান করেন। তার মর্যাদা, তাকওয়া ও আল্লাহর পথে আহ্বানের কারণে তিনি ইহুদিদের চক্ষুশূলে পরিণত হন এবং বায়তুল মুকাদ্দাসের ভেতরেই তাকে শহিদ করা হয়।

হজরত ঈসা ইবনে মারইয়াম আলাইহিস সালাম। তিনি ফিলিস্তিনের বায়তুল লাহামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাবার হস্তক্ষেপ ছাড়াই আল্লাহর কুদরতে পৃথিবীতে আগমন করেন। শৈশবেই তিনি নবুয়তের ঘোষণা দেন এবং মায়ের পবিত্রতার সাক্ষ্য দেন। মারইয়াম (আ.) বলল, আমার ছেলে হবে কীভাবে, অথচ আমাকে কোনো পুরুষ স্পর্শ করেনি। আমি কোনো ব্যভিচারিণীও নই। ফেরেশতা বলল এভাবেই হবে। তোমার রব বলেছেন, আমার পক্ষে এটা একটি মামুলি কাজ। আমি এটা এজন্য করব, যেন একে আমি মানুষের জন্য নিদর্শন ও আমার কাছ থেকে রহমত বানাতে পারি। এটি একটি স্থির বিষয়।

হজরত ঈসা (আ.) তিনি ফিলিস্তিন অঞ্চলে আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত দেন। মায়ের সঙ্গে মিসরেও যান এবং সেখান থেকে আবার ফিলিস্তিনে ফিরে আসেন। অভিশপ্ত ইহুদিরা তাকে জারজ সন্তান ও তার মাকে অপবাদ দেয়। তারা তাকে হত্যার পরিকল্পনা করলে আল্লাহতায়ালা তাকে জীবিত অবস্থায় আকাশে উঠিয়ে নেন।

কিয়ামতের আগে হজরত ঈসা আলাইহিস সালাম পুনরায় ফিলিস্তিনের বায়তুল মুকাদ্দাসে অবতরণ করবেন। তিনি দাজ্জালকে হত্যা করবেন এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন। এরপর তার মৃত্যু হলে নবি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওজার পাশে তাকে সমাহিত করা হবে।

ফিলিস্তিনের এই পবিত্র মাটি যুগে যুগে বহন করেছে আল্লাহর নবি ও রাসুলদের স্মৃতি। এই ভূমি আজও বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। এর প্রতিটি ধূলিকণা যেন সাক্ষ্য দেয় সেসব মহান ব্যক্তিত্বের, যারা আল্লাহর বাণীকে সমুন্নত রাখতে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। ফিলিস্তিন শুধু একটি ভূখণ্ড নয়, এটি ঈমান আর ঐতিহ্যের এক জীবন্ত ইতিহাস।

নিউজটি শেয়ার করুন
ট্যাগসঃ

বিস্তারিত লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষণ করুন

যে ভূমিতে যুগে যুগে অসংখ্য নবি-রাসুল আগমন করেন

আপডেট সময়ঃ ০৯:৫৬:২৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৮ অগাস্ট ২০২৫

ফিলিস্তিন এক পবিত্র ভূমি। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই মাটি বহন করেছে অসংখ্য নবি ও রাসুলের পদচিহ্ন। এটি হিজরতের ভূমি, মহান আল্লাহর অশেষ বরকতের ভূমি। এখানেই অবস্থিত মুসলিমদের তৃতীয় পবিত্রতম স্থান মসজিদুল আকসা।

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআনে এই মসজিদের মহিমা বর্ণনা করেছেন, ‘পবিত্র সেই সত্তা, যিনি নিজ বান্দাকে রাতারাতি মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসায় নিয়ে যান, যার চারপাশকে আমি বরকতময় করেছি।’

ফিলিস্তিন নিজের বুকে ধারণ করেছে এমন সব নবি-রাসুল, যাদের পদস্পর্শে এই মাটি ধন্য হয়েছে। মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে শেষ নবি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত বহু নবি এই পবিত্র ভূমিতে আগমন করেছেন। আজ আমরা সেসব মহান ব্যক্তিত্বের কথা জানব, যারা ফিলিস্তিনকে করেছেন মহিমান্বিত।

হজরত ইবরাহিম খলিলুল্লাহ আলাইহিস সালাম। তিনি ইরাকের বাবেল শহরে জন্ম করেন। আল্লাহর একত্ববাদের বাণী প্রচার করতে গিয়ে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিলেন তিনি। নিজ বাবার কাছ থেকে পেয়েছিলেন দেশান্তরের হুমকি। কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘হে ইবরাহিম। তুমি কি আমার উপাস্যদের থেকে বিমুখ? যদি তুমি বিরত না হও তবে অবশ্যই আমি পাথরের আঘাতে তোমার প্রাণ নাশ করব। আর তুমি চিরতরে আমাকে ত্যাগ করে চলে যাও।’ (সুরা মারইয়াম, আয়াত ৪৬)

ঈমান রক্ষার তাগিদে হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের স্ত্রী সারা ও ভাতিজা লুতকে সঙ্গে নিয়ে প্রথমে হাররান, তারপর হালব হয়ে হিজরত করেন ফিলিস্তিনের বায়তুল মুকাদ্দাসে। ফিলিস্তিনেই তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন এবং জেরুজালেমে তাকে সমাহিত করা হয়।

বায়তুল মুকাদ্দাসে হিজরতের পর দীর্ঘ ২০ বছর হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম ছিলেন নিঃসন্তান। বিবি সারার পরামর্শে তিনি দাসী হাজেরাকে বিবাহ করেন। হাজেরার গর্ভে ফিলিস্তিনে জন্ম নেন হজরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম। পরবর্তী সময়ে আল্লাহর নির্দেশে হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম শিশু ইসমাঈল ও হাজেরাকে মক্কায় রেখে আসেন।

আল্লাহতায়ালা কোরআনে বলেন, হে আমার প্রতিপালক। আমি আমার কিছু বংশধরকে আপনার সম্মানিত ঘরের আশপাশে বসবাস করিয়েছি, এমন এক উপত্যকায়, যেখানে কোনো ক্ষেত-খামার নেই। হে আমাদের প্রতিপালক। যাতে তারা নামাজ কায়েম করে। মানুষের অন্তরে তাদের প্রতি অনুরাগ সৃষ্টি করে দিন। তাদের ফলমূলের রিজিক দান করুন। যাতে তারা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে। আর হজরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম মক্কায়ই জীবন অতিবাহিত করেন এবং সেখানেই সমাহিত হন।

হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের দ্বিতীয় পুত্র হজরত ইসহাক আলাইহিস সালাম। তিনিও জন্মগ্রহণ করেন ফিলিস্তিনে। বৃদ্ধ বয়সে স্ত্রী সারার গর্ভে তার জন্মের সুসংবাদ পেয়ে হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। সব প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাকে বৃদ্ধ বয়সে ইসমাঈল ও ইসহাক দিয়েছেন। নিশ্চয় আমার প্রতিপালক অত্যধিক দোয়া শ্রবণকারী। (সুরা ইবরাহিম, আয়াত ৩৯) হজরত ইসহাক আলাইহিস সালাম বাবার সঙ্গে ফিলিস্তিনেই বসবাস করেন এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করে সমাহিত হন।

হজরত লুত আলাইহিস সালাম। তিনি এই বৃহত্তর ফিলিস্তিনের অধিবাসী ছিলেন। তিনি হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের প্রতি ঈমান এনে তার সঙ্গে ফিলিস্তিনে হিজরত করেছিলেন। পরে তিনি আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার জন্য সাদুম ও আমুরায় যান, যা বর্তমানে মৃত সাগর ও তার তীরবর্তী এলাকা হিসেবে পরিচিত। সেখানকার অধিবাসীরা ছিল অত্যন্ত নিকৃষ্ট চরিত্রের, তারা সমকামিতায় লিপ্ত ছিল।

হজরত লুত আলাইহিস সালাম তাদের এই ঘৃণিত কাজ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান। আল্লাহ কোরআনে বলেন, ‘আমি লুতকে প্রেরণ করেছি। যখন সে নিজ জাতিকে বলল, তোমরা কি এমন অশ্লীল কাজ করছ, যা তোমাদের আগে সারা বিশ্বের কেউ করেনি। তোমরা তো কামবশত নারীদের ছেড়ে পুরুষদের কাছে গমন করো। বরং তোমরা সীমালঙ্ঘন করছ।’ (সুরা আরাফ, আয়াত ৮০-৮১) তাদের পাপের কারণে আল্লাহর গজব নেমে আসে এবং হজরত লুত আলাইহিস সালাম ও তার ঈমানদার সঙ্গীরা রক্ষা পান।

হজরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম, যিনি ইসরাইল নামেও পরিচিত ছিলেন, হজরত ইসহাক আলাইহিস সালামের ছেলে এবং হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের নাতি। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ফিলিস্তিনে। ভাইয়ের সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় তিনি কিছুদিনের জন্য দক্ষিণ ইরাকের ফাদ্দান আরামে যান। সেখানে দীর্ঘ সময় অবস্থানের পর স্ত্রী-সন্তানসহ তিনি পুনরায় ফিলিস্তিনে ফিরে আসেন। হজরত ইয়াকুব আলাইহিস সালামের ১২ জন ছেলে সন্তান ছিল।

জীবনের শেষদিকে তিনি মিসরে হিজরত করেছিলেন এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। তবে মৃত্যুর আগে তিনি সন্তানদের অছিয়ত করেছিলেন, মিসর ত্যাগ করার সময় যেন তার লাশ ফিলিস্তিনে নিয়ে যাওয়া হয়। তার অছিয়ত অনুযায়ী, তার লাশ ফিলিস্তিনে আনা হয় এবং বায়তুল মুকাদ্দাসের পবিত্র ভূমিতে সমাহিত করা হয়।

হজরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম। তিনি ছিলেন হজরত ইয়াকুব আলাইহিস সালামের ছেলে। তার জীবনের ঘটনা কোরআনে ‘আহসানুল কাসাস’ অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ কাহিনি হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। তার জন্ম দক্ষিণ ইরাকের ফাদ্দান আরামে হলেও, শৈশবের কিছু সময় তিনি বাবার সঙ্গে ফিলিস্তিনেই কাটিয়েছিলেন। ছোটবেলায় ভাইয়ের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে তিনি মিসরে যান এবং পরবর্তী সময়ে নবুয়ত লাভ করে মিসরের মন্ত্রী হন। তিনি তার বাবা ও ভাইদের মিসরে নিয়ে আসেন এবং সেখানেই তার মৃত্যু হয়। তবে তার শেষ ইচ্ছানুযায়ী, তার লাশকেও ফিলিস্তিনের বায়তুল মুকাদ্দাসে স্থানান্তর করা হয়।

হজরত দাউদ আলাইহিস সালাম। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ফিলিস্তিনে এবং একই সঙ্গে ছিলেন নবি ও বাদশাহ। পাহাড়-পর্বত ও পাখিরা তার অনুগত ছিল। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি দাউদকে বিশেষভাবে অনুগ্রহ দান করেছি। হে পাহাড়-পর্বত, হে পাখিরা, তোমরাও দাউদের সঙ্গে আমার তাসবিহ পড়ো। আর আমি তার জন্য লোহাকে নরম করে দিয়েছিলাম।’ (সুরা সাবা, আয়াত ১০)

নবুয়ত লাভের আগে তিনি ফিলিস্তিনিদের পক্ষে জালুতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন এবং তাকে হত্যা করেন। তিনি আসদুদ, বাইতে দুজান, আবু গাওস, বায়তুল মুকাদ্দাস ও রামলার শাসক ছিলেন। ফিলিস্তিনেই তিনি ইন্তেকাল করেন এবং বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে রামলাগামী পথের পাশে একটি পাহাড়ে তাকে সমাহিত করা হয়।

হজরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম। তিনি ছিলেন হজরত দাউদ আলাইহিস সালামের ছেলে। তিনি ছিলেন আল্লাহর নবি এবং পৃথিবীর অন্যতম প্রভাবশালী শাসক। আল্লাহতায়ালা পশুপাখি, বায়ুমণ্ডল ও জিন জাতিকে তার অধীন করে দিয়েছিলেন। এই মহান নবির জন্ম ও জীবনযাপন ছিল ফিলিস্তিন কেন্দ্রিক। তিনি ঐতিহাসিক বায়তুল মুকাদ্দাস মসজিদের নির্মাতা। খ্রিষ্টপূর্ব ৯২৩ সালে ফিলিস্তিনেই তিনি ইন্তেকাল করেন এবং বায়তুল মুকাদ্দাসে তাকে দাফন করা হয়।

আল্লাহর আরেক নবি হজরত ইয়াহইয়া আলাইহিস সালাম। তিনিও ফিলিস্তিনের বায়তুল মুকাদ্দাসে জন্মগ্রহণ করেন। হজরত জাকারিয়া আলাইহিস সালামের দোয়ায় বৃদ্ধ বয়সে আল্লাহ তাকে দান করেন। তার মর্যাদা, তাকওয়া ও আল্লাহর পথে আহ্বানের কারণে তিনি ইহুদিদের চক্ষুশূলে পরিণত হন এবং বায়তুল মুকাদ্দাসের ভেতরেই তাকে শহিদ করা হয়।

হজরত ঈসা ইবনে মারইয়াম আলাইহিস সালাম। তিনি ফিলিস্তিনের বায়তুল লাহামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাবার হস্তক্ষেপ ছাড়াই আল্লাহর কুদরতে পৃথিবীতে আগমন করেন। শৈশবেই তিনি নবুয়তের ঘোষণা দেন এবং মায়ের পবিত্রতার সাক্ষ্য দেন। মারইয়াম (আ.) বলল, আমার ছেলে হবে কীভাবে, অথচ আমাকে কোনো পুরুষ স্পর্শ করেনি। আমি কোনো ব্যভিচারিণীও নই। ফেরেশতা বলল এভাবেই হবে। তোমার রব বলেছেন, আমার পক্ষে এটা একটি মামুলি কাজ। আমি এটা এজন্য করব, যেন একে আমি মানুষের জন্য নিদর্শন ও আমার কাছ থেকে রহমত বানাতে পারি। এটি একটি স্থির বিষয়।

হজরত ঈসা (আ.) তিনি ফিলিস্তিন অঞ্চলে আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত দেন। মায়ের সঙ্গে মিসরেও যান এবং সেখান থেকে আবার ফিলিস্তিনে ফিরে আসেন। অভিশপ্ত ইহুদিরা তাকে জারজ সন্তান ও তার মাকে অপবাদ দেয়। তারা তাকে হত্যার পরিকল্পনা করলে আল্লাহতায়ালা তাকে জীবিত অবস্থায় আকাশে উঠিয়ে নেন।

কিয়ামতের আগে হজরত ঈসা আলাইহিস সালাম পুনরায় ফিলিস্তিনের বায়তুল মুকাদ্দাসে অবতরণ করবেন। তিনি দাজ্জালকে হত্যা করবেন এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন। এরপর তার মৃত্যু হলে নবি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওজার পাশে তাকে সমাহিত করা হবে।

ফিলিস্তিনের এই পবিত্র মাটি যুগে যুগে বহন করেছে আল্লাহর নবি ও রাসুলদের স্মৃতি। এই ভূমি আজও বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। এর প্রতিটি ধূলিকণা যেন সাক্ষ্য দেয় সেসব মহান ব্যক্তিত্বের, যারা আল্লাহর বাণীকে সমুন্নত রাখতে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। ফিলিস্তিন শুধু একটি ভূখণ্ড নয়, এটি ঈমান আর ঐতিহ্যের এক জীবন্ত ইতিহাস।

নিউজটি শেয়ার করুন